ক্রীনা চমকে উঠে বলল, তুমি কী বলছ কিহিতা?
আমি ঠিকই বলছি ক্রীনা। কিহিতা শান্ত গলায় বলল, সত্যি কথা বলতে কী রুখের দেহে অবস্থানকারী প্রাণীটিকে মানববসতিতে আনা খুব অবিবেচকের মতো কাজ হয়েছে।
রুহান খানিকটা বিচলিত হয়ে কিহিতার দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি বারবার রুখের দেহে অবস্থানকারী প্রাণী বলে উল্লেখ করছ। কিন্তু রুখ কোনো মহাজাগতিক প্রাণী নয়। রুখ হচ্ছে রুখ।
তার একটা অংশ রুখ। মূলত সে একটি মহাজাগতিক প্রাণী। লাল চুলের মাহিনা জিজ্ঞেস করল, তর্ক করে লাভ নেই, কিহিতা তুমি কী করতে চাও স্পষ্ট করে বল।
তোমরা একটি সহজ কথা ভুলে যাও। মেতসিসে আমরা বুদ্ধিমান এনরয়েডের অনুগ্রহে বসবাসকারী কিছু মানুষ। তারা না চাইলে একমুহূর্তে আমরা শেষ হয়ে যাব। তাদের সাথে সহযোগিতা করে যদি আমরা কয়দিন বেশি বেঁচে থাকতে পারি সেটিই আমাদের সার্থকতা। তাদের সাথে যুদ্ধ করে শেষ হয়ে যাওয়া নির্বুদ্ধিতা।
মহিলা একটু অধৈর্য হয়ে বলল, তুমি এখনো বলছ না তুমি ঠিক কী করতে চাও।
আমি রুখকে বুদ্ধিমান এনরয়েডের কাছে ফিরিয়ে দিতে চাই।
ক্রীনা ক্রুদ্ধস্বরে বলল, সেটি তুমি কীভাবে করতে চাও?
রুখকে হত্যা করে।
হলঘরের সবাই চমকে উঠল। ক্রীনা অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে কিহিতার দিকে তাকাল, কাঁপা গলায় বলল, তুমি–তুমি–এ কী বলছ কিহিতা?
আমি মানববসতির নিরাপত্তার দায়িত্বে আছি কীনা। আমাকে সবার কথা ভাবতে হবে। একটি মহাজাগতিক প্রাণীর জন্য
ক্রীনা চিৎকার করে বলল, তুমি এভাবে কথা বলতে পারবে না, কিহিতা।
রুহান সরু চোখে কিহিতার দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি কেমন করে জান রুখকে হত্যা করাই হচ্ছে এই সমস্যার সমাধান?
কিহিতা শীতল গলায় বলল, আমি নিশ্চিত সেটিই হচ্ছে সমাধান।
কিন্তু তারা হত্যা করতে পারে নি।
আমরা মানুষ–মানুষের দুর্বলতা আমরা জানি। আমরা সম্ভবত এই কাজটি আরো সুচারুভাবে করতে পারব।
কিন্তু এটাই কি সমাধান?
লাল চুলের মাহিনা বলল, কিহিতার কথায় খানিকটা যুক্তি রয়েছে। এই মহাজাগতিক প্রাণী নিজে নিজে আসে নি। সে রুখের উপর ভর করে এসেছে। একটি প্রাণীকে যদি তার অস্তিত্বের জন্য অন্য একটি পোষকের উপর নির্ভর করতে হয় তা হলে সেই পোষককে হত্যা করা হলে প্রাণীটি বেঁচে থাকতে পারে না। এখানে রুথ হচ্ছে পোষক, তাকে হত্যা করে সম্ভবত মহাজাগতিক প্রাণীটিকে হত্যা করা সম্ভব।
ক্রীনা মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, তোমরা কি সবাই পাগল হয়ে গেছ? একজন মানুষকে বলছ পোষক! তাকে হত্যা করার কথা বলছ এত সহজে যেন সে মানুষ নয়, যেন সে একটি কীটপতঙ্গ!
কিহিতা ক্রীনার দিকে তাকিয়ে বলল, ব্যাপারটিকে ব্যক্তিগত পর্যায়ে নিও না ক্রীনা। কারো বিরুদ্ধে আমরা কিছু করছি না। আমরা মানববসতিকে রক্ষা করার কথা বলছি।
তোমরা নিশ্চিত এটাই মানববসতিকে রক্ষা করবে?
আমরা জানি না। কিন্তু আমরা তো হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারি না। আমাদের কিছু একটা করতে হবে। আমরা যদি রুখকে হত্যা করতে পারি তা হলে মহাজাগতিক প্রাণীকে হত্যা করতে পারব। এ কথাটি তোমরা ভুলে যেও না আমরা এখানে বুদ্ধিমান এনরয়েডের অনুকম্পার উপর বেঁচে আছি। তাদেরকে যেভাবে সম্ভব সেভাবে সন্তুষ্ট রাখতে হবে। প্রাচীনকালে মানুষ যেভাবে অন্ধ বিশ্বাসে ঈশ্বরের আরাধনা করত আমাদের ঠিক সেই
একাগ্রতা এবং বিশ্বাস নিয়ে বুদ্ধিমান এনরয়েডদের পূজা করতে হবে। এটাই হচ্ছে আমাদের বেঁচে থাকার একমাত্র উপায়।
ক্রীনা চিৎকার করে বলল, বিশ্বাস করি না। আমি তোমার একটি কথাও বিশ্বাস করি। তুমি উন্মাদ।
তুমি কী বিশ্বাস কর বা না কর তাতে কিছু আসে–যায় না। আমি মানববসতির নিরাপত্তার দায়িত্বে আছি। এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেব আমি।
তুমি বলতে চাইছ তুমি আমাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে
হ্যাঁ। প্রয়োজন হলে তোমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে।
ক্রীনার সমস্ত মুখমণ্ডল ক্রোধে রক্তবর্ণ হয়ে ওঠে। সে ঘুরে সবার দিকে তাকাল। তীব্র কণ্ঠে বলল, তোমরা সবাই এই সিদ্ধান্তকে সমর্থন কর?
না। রুহান মাথা নেড়ে বলল, আমি সমর্থন করি না। কিহিতার সিদ্ধান্ত হচ্ছে একটি অত্যন্ত জটিল সমস্যার একটি অবিশ্বাস্যরকম সরল এবং হাস্যকর সমাধান। এটি সরল এবং অমানবিক। রুখ আমাদের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠজন, তাকে এত সহজে–
আমি এই ব্যাপার নিয়ে কথা বলতে চাই না। কিহিতা কঠিন গলায় বলল, কিছু কিছু সিদ্ধান্ত যুক্তিতর্ক ছাড়াই নিতে হয়।
তুমি এই সিদ্ধান্ত নিতে পার না।
আমি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। যারা এর বিরোধিতা করবে আমাকে তাদের বিরুদ্ধে কঠিন ব্যবস্থা নিতে হবে।
রুহান এবং ক্রীনা এক ধরনের অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে কিহিতার দিকে তাকিয়ে রইল। কিহিতা পাথরের মতো নির্লিপ্ত মুখে তার পকেট থেকে যোগাযোগ–মডিউল বের করে নিরাপত্তা কেন্দ্রে যোগাযোগ করে। সে
কিছুক্ষণের মাঝেই ক্রীনা এবং রুহান নিজেদেরকে একটা ছোট ঘরে বন্দী হিসেবে আবিষ্কার করল।
১৩. চার জন শক্তিশালী মানুষ
কিহিতার সামনে চার জন শক্তিশালী মানুষ অস্ত্র হাতে দাঁড়িয়ে ছিল, আপাতদৃষ্টিতে তাদের ভাবলেশহীন মনে হলেও ভালো করে লক্ষ করলে দেখা যাবে তারা খানিকটা বিচলিত। চোখের কোনায় যে চাপা অনুভূতিটি সেটি ভীতি।
কিহিতা তাদের সবাইকে ভালো করে লক্ষ করে বলল, আমরা মানববসতিতে এই প্রথমবার এমন একটি কাজ করতে যাচ্ছি যেটি আগে কখনো করা হয় নি। কাজটি হচ্ছে হত্যাকাণ্ড। আমরা যাকে হত্যা করতে যাচ্ছি তার বাইরের অবয়ব একটি মানুষের। প্রকৃতপক্ষে আমরা যাকে হত্যা করতে যাচ্ছি তার বাইরের অবয়ব আমাদের অতি পরিচিত রুখের। কিন্তু সে রুখ নয় তার ডি. এন. এ. –তে ডাবল হেলিক্স নেই, সেটি ষষ্ঠ মাত্রার হেলিক্স। বেস পেয়ার বারোটি। তোমাদের কেউ কেউ দেখেছ সে হেঁচকা টান দিয়ে টাইটেনিয়ামের একটি রেলিং ভেঙে ফেলেছে।