রুখ চমকে ঘুরে তাকাল। সে সিঁড়ির রেলিং ধরে রেখেছিল চমকে ঘুরে তাকানোর সময় রেলিঙে তার হাতের হেঁচকা টান পড়ল এবং সবাই অবাক হয়ে দেখল টাইটেনিয়ামের রেলিঙের অংশবিশেষ ভেঙে চলে এসেছে। রুখ রেলিঙের ছিন্ন অংশটুকু হাতে নিয়ে হতচকিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল, অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে বলল, আরে, ভেঙে গেল দেখছি।
একজন মানুষের হাতের আলতো স্পর্শে টাইটেনিয়ামের ধাতব রেলিং ভেঙে যেতে পারে ব্যাপারটি বিশ্বাসযোগ্য নয়, দৃশ্যটি দেখে সবাই কেন জানি এক ধরনের আতঙ্কে শিউরে উঠল। রুথ ভাঙা অংশটি আবার তার জায়গায় বসিয়ে সেটি ঠিক করার চেষ্টা করতে থাকে। ক্রীনা সবার আগে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, রেলিংটা নিশ্চয়ই ভাঙা ছিল।
রুহান মাথা নাড়ল, বলল, মানববসতির রক্ষণাবেক্ষণ কমিটিকে একটা কড়া নোটিশ পাঠানোর সময় হয়েছে।
ঠিকই বলেছ। ক্রীনা রুখের পিঠ স্পর্শ করে বলল, চল রুখ, তুমি শুয়ে একটু বিশ্রাম নেবে। তোমার উপর দিয়ে অনেক ধকল গিয়েছে।
রুখ মাথা নাড়ল, বলল, ঠিকই বলেছ। ঠিক বুঝতে পারছি না, কিন্তু আমার কেমন জানি অস্থির লাগছে।
শুয়ে খানিকক্ষণ বিশ্রাম নাও, ঠিক হয়ে যাবে। ক্রীনা ঘুরে রুহানের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি একটু অপেক্ষা কর, আমি রুখকে শুইয়ে দিয়ে আসছি।
রুহান চিন্তিত মুখে বলল, আমি আসব?
না। প্রয়োজন নেই।
ক্রীনা রুখকে তার ঘরে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে খানিকক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে রইল, রুখ বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে ছাদের দিকে তাকিয়ে আছে। ক্রীনা নরম গলায় ডাকল, রুখ।
বল।
তোমার কী হয়েছে, রুখ?
আমি জানি না। শুধু মনে হচ্ছে, আমার ভিতরে আরো একজন আছে।
সে কে?
আমি জানি না।
সে কী চায়?
আমি জানি না। রুখ কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, মাঝে মাঝে মনে হয় আমি বুঝি আমি নই। মনে হয়–
কী মনে হয়?
মনে হয় আমি বুঝি অন্য কিছু।
সব তোমার মনের ভুল। শুয়ে একটু বিশ্রাম নাও, ঘুম থেকে উঠে দেখবে সব ঠিক হয়ে গেছে।
রুথ শিশুর মতো মাথা নেড়ে বলল, ঠিক আছে।
ক্রীনা দরজা বন্ধ করে চলে আসছিল, তখন রুখ পিছন থেকে ডাকল, বলল, ক্রীনা।
কী হল?
এই যে রেলিঙের ব্যাপারটা
রুথ কী বলতে চাইছে ক্রীনার বুঝতে অসুবিধে হল না কিন্তু তবু সে না বোঝার ভান করে বলল, কোন রেলিং?
এই যে আমার হেঁচকা টানে সেটা ভেঙে গেল।
কী হয়েছে সেই রেলিঙের?
সেটা আসলে আমি ভেঙেছি। তাই না?
ক্রীনা এক মুহূর্ত রুখের দিকে তাকিয়ে বলল, সেটা কি সম্ভব?
না। কিন্তু আমার ভিতরে যে আরেকজন আছে বলে মনে হয়–তার পক্ষে সম্ভব।
ক্রীনা একটা চাদর দিয়ে রুখের শরীরকে ঢেকে দিতে দিতে বলল, এটা নিয়ে তুমি এখন চিন্তা কোরো না। তুমি ঘুমাও রুখ। আমি আসছি।
ক্রীনা বের হয়ে দেখল, বাইরে রুহান এবং সাথে আরো কয়েকজন নিঃশব্দে অপেক্ষা করছে। ক্রীনা বের হতেই সবাই তার দিকে জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল। ক্রীনা হঠাৎ করে কেমন জানি ক্লান্তি অনুভব করতে থাকে।
রুহান একটু এগিয়ে এসে বলল, ক্রীনা।
কী হল?
রুখের কী হয়েছে ক্রীনা?
আমি যদি সত্যিই জানতাম তা হলে খুব নিশ্চিন্ত বোধ করতাম।
তুমি জান না?
সে কিসের ভিতর দিয়ে গিয়েছে আমি জানি–কিন্তু তার কী হয়েছে আমি জানি না। তোমরা এস, আমি যেটুকু জানি সেটুকু বলছি।
.
বড় হলঘরটাতে সবাই পাথরের মতো মুখ করে বসে আছে। রুহান সবাইকে এখানে উপস্থিত থাকার অনুমতি দেয় নি। শুধুমাত্র মানববসতির পরিচালনা পর্ষদের সদস্যরা রয়েছে। ক্রীনার মুখে পুরো ঘটনার বর্ণনা শুনে সবাই একেবারে হতচকিত হয়ে গিয়েছে। দীর্ঘ সময় কেউ কোনো কথা বলার মতো কিছু পেল না। শেষে রুহান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, আমরা খুব বিপদের মাঝে আছি। সবচেয়ে বড় বিপদের মাঝে রয়েছে রুখ।
মানববসতি পরিচালনা পর্ষদের নিরাপত্তা শাখার দায়িত্বে নিয়োজিত মানুষটির নাম কিহিতা। তার সুগঠিত শক্তিশালী বিশাল দেহ। মধ্যবয়স্ক এই মানুষটি সাহসী এবং খুব কম কথার মানুষ। ক্রীনা যতক্ষণ কথা বলেছে সে খুব মনোযোগ দিয়ে নিজের বিশাল হাতের শক্তিশালী আঙুলের নখগুলো পরীক্ষা করেছে। সে একবারও ক্রীনার দিকে তাকায় নি কিংবা তাকে কোনো প্রশ্ন করে নি। কিহিতা রুহানের দিকে তাকিয়ে বলল, আমি তোমার সাথে একমত নই।
তুমি কী বলতে চাইছ?
এখানে রুথ সবচেয়ে বিপদগ্রস্ত নয়। সে বিপদেরর কারণ।
ক্রীনা চমকে উঠে বলল, কী বলছ তুমি কিহিতা?
আমি ঠিকই বলছি। আজকে কী অবলীলায় সে টাইটেনিয়ামের রেলিংটা ভেঙে ফেলেছে সেটা দেখেছ?
কিন্তু—কিন্তু–
কীভাবে চোখের পলকে সে বিশাল ভয়ঙ্কর রোবট তৈরি করতে পারে সেটা তুমি নিজেই বলেছ ক্রীনা। রুশ বিপদগ্রস্ত নয়–রুখ বিপদের কারণ।
ক্রীনা একটু আহত দৃষ্টিতে কিহিতার দিকে তাকিয়ে রইল। কিহিতা ক্রীনার দৃষ্টি উপেক্ষা করে বলল, আমরা সম্ভবত মেতসিসে কিছু নিয়ম ভঙ্গ করেছি। আমাদের সম্ভবত বুদ্ধিমান এনরয়েডদের বিরুদ্ধাচরণ না করে তাদের সহযোগিতা করা উচিত।
পরিচালনা পর্ষদের স্বাস্থ্য শাখার দায়িত্বে নিয়োজিত লাল চুলের মেয়ে মাহিনা কিহিতার দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি কী ধরনের সহযোগিতার কথা বলছ?
কিহিতা চোখ নামিয়ে বলল, আমার কথাটি তোমাদের কাছে নিষ্ঠুরতা বলে মনে হতে পারে, কিন্তু আমি মনে করি রুখের দেহে অবস্থানকারী প্রাণীটিকে বুদ্ধিমান এনরয়েডের কাছে পৌঁছে দেওয়া উচিত।