তুমি দেখতে কেমন?
আমার কাছে দেখার কোনো অর্থ নেই
তোমার অবয়ব কেমন? আকৃতি কেমন?
এই কথার কোনো অর্থ নেই। আমি রূপহীন আকৃতিহীন।
আমাকে নিয়ে তুমি কী করবে?
দেখব।
কেমন করে দেখবে?
তোমাকে খুলে খুলে দেখব। একটি একটি পরমাণু খুলে খুলে দেখব।
দেখে কী করবে?
বুঝব।
কেন?
কৌতূহল। বুদ্ধিমত্তার আরেক নাম হচ্ছে কৌতূহল।
রুখের চেতনা ধীরে ধীরে অসাড় হয়ে আসে। সে কি আছে না নেই সেটিও অস্পষ্ট হয়ে আসে। তার মনে হতে থাকে যুগ যুগ থেকে সে আদিহীন অন্তহীন এক অসীম শূন্যতায় ভেসে আছে। সময় যেন স্থির হয়ে আছে তাকে ঘিরে।
এভাবে কতকাল কেটে গেছে কে জানে? রুখের মনে হতে থাকে সে বুঝি তার পুরো জীবন কাটিয়ে দিয়েছে। এক অসীম শূন্যতা থেকে তার বুঝি আর মুক্তি নেই। তখন হঠাৎ কে যেন বলল, চল।
রুপের মনে হল এখন আর কিছুতেই কিছু আসে যায় না।
কে যেন আবার বলল, চল।
কোথায়?
ফিরে যাই।
ফিরে যাবে?
হ্যাঁ।
কে ফিরে যাবে? কোথায় ফিরে যাবে?
তুমি। তুমি আর আমি।
আমি? আমি আর তুমি?
হ্যাঁ।
তুমিও আমার সাথে যাবে?
হ্যাঁ।
কেমন করে যাবে?
তোমার চেতনার সাথে।
ও।
রুখের হঠাৎ মনে হতে থাকে সে বুঝি ধীরে ধীরে জেগে উঠছে। মনে হতে থাকে তার দেহ সে ফিরে পেয়েছে। হাত দিয়ে সে নিজেকে স্পর্শ করে, হাত–পা–মুখ নতুন করে আবিষ্কার করে। চিৎকার করে সে ধ্বনি শুনতে পায়। চোখ খুলে নিচ্ছিদ্র অন্ধকারের মাঝে সূক্ষ্ম আলোর রেখা দেখতে পায়। হঠাৎ করে সেই আলো হঠাৎ তীব্র ঝলকানি হয়ে তাকে প্রায় দৃষ্টিহীন করে দেয়। রুখ চিৎকার করে ওঠে– প্রচণ্ড এক অমানবিক শক্তি যেন তাকে ছিন্নভিন্ন কর দিয়ে দূরে ছিটকে দেয়। রুখ কোথায় যেন আছড়ে পড়ল, প্রচণ্ড আঘাতে তার দেহ যন্ত্রণায় কুঁকড়ে ওঠে। কাতর চিৎকার করে সে কিছু একটা আঁকড়ে ধরতে চেষ্টা করে, শক্ত পাথরকে সে খামচে ধরে। মুখের মাঝে সে রক্তের লোনা স্বাদ অনুভব করে।
সমুদ্রের গর্জনের মতো চাপা কলরব শুনতে পায়–চোখ খুলে সে দেখে তার পরিচিত জগৎ। সে ফিরে এসেছে। মেতসিসে ফিরে এসেছে।
রুখ চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকে, নিজের ভিতরে হঠাৎ সে একটা ভয়ের কাপুনি অনুভব করে।
সে একা ফিরে আসে নি। তার সাথে আরো কেউ আছে।
১১. উঁচু একটা বিছানায় শুয়ে
রুখ উঁচু একটা বিছানায় শুয়ে আছে। তাকে ঘিরে কয়েকটি বুদ্ধিমান এনরয়েড দাঁড়িয়ে আছে। তার বুকের কাছাকাছি কিছু যন্ত্র। রুখের হাত এবং পা স্টেনলেস স্টিলের রিং দিয়ে আটকানো। শরীর থেকে নানা আকারের কিছু টিউব বের হয়ে আছে। দেহের কাছাকাছি অসংখ্য মনিটর।
একটা বড় মনিটরের সামনে রয়েড দাঁড়িয়ে আছে, তার চেহারায় দুশ্চিন্তার চিহ্ন। ক্রীনা জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে রয়েড।
এটি রুখ নয়।
ক্রীনা আতঙ্কে শিউরে উঠল, চাপা গলায় বলল, কী বলছ তুমি?
হ্যাঁ। এটি মানুষ নয়।
মানুষ নয়?
না। তার ডি.এন. এ.–তে আরো নতুন বারো জোড়া বেস পেয়ার জুড়ে দেওয়া আছে।
তার মানে কী?
ডি, এন, এ হচ্ছে মানুষের ব্লু প্রিন্ট। তার ভিতরে একজন মানুষের সব তথ্য সাজানো থাকে। এর মাঝে ডি, এন. এ.–তে নতুন বেস পেয়ার এসেছে, নতুন তথ্য এসেছে। সেই নতুন তথ্যের পরিমাণ অচিন্তনীয়।
তার মানে কী?
তার মানে এটি মানুষ নয়।
তা হলে এ–এ–কে?
মহাজাগতিক প্রাণীর একটি ডিকয়।
না! ক্রীনা চাপা গলায় আর্তনাদ করে বলল, না–এটা হতে পারে না। এ হচ্ছে রুখ। নিশ্চয়ই রুখ।
রুখ মানুষ ছিল। এটি মানুষ নয়। মানুষের ডি, এন, এ ডাবল হেলিক্স, এখানে ছয় জোড়া হেলিক্সই আছে। আরো নতুন বারো জোড়া বেস পেয়ার।
এখন কী হবে?
এই ডিকয়টিকে বিশ্লেষণ করতে হবে।
বিশ্লেষণ?
হ্যাঁ। কেটে দেখতে হবে, শরীরের অংশ বুঝতে হবে। নতুন তথ্য জানতে হবে।
কিন্তু রুখের কী হবে?
রুখ? রুখ বলে এখানে কেউ নেই
রয়েড এক পা সামনে এগিয়ে গিয়ে এনরয়েডদের সাথে কথা বলে, বিজাতীয় যান্ত্রিক ভাষার দ্রুত লয়ের কথা–ক্রীনা তা ধরতে পারে না। ক্রীনা ভীত মুখে তাকিয়ে থাকে। আতঙ্কিত হয়ে দেখে উপর থেকে একটা যন্ত্র নেমে আসছে, নিচে ধারালো স্ক্যালপেল ঘুরছে। তার রুখকে এরা মেরে ফেলবে। ক্রীনা ছুটে গিয়ে রয়েডের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। রয়েডের যান্ত্রিক শক্তিশালী দেহ এক ঝটকায় তাকে দূরে ছুঁড়ে দেয়। দুটি প্রতিরক্ষা রোবট ক্রীনাকে ধরে ফেলে শক্ত হাতে আটকে রাখল। ক্রীনা অসহায় আতঙ্কে তাকিয়ে থাকে, উপর থেকে ধারালো স্ক্যালপেল নিচে নেমে আসছে আর একমুহূর্ত পরে সেটি রুখের পাজর কেটে ভিতরে বসে যাবে। ক্রীনা আতঙ্কে চিৎকার করে উঠল।
সাথে সাথে স্ক্যালপেলটি থেমে গেল। ক্রীনা অবাক হয়ে দেখল সেটি আবার উপরে উঠে যাচ্ছে। রয়েড হতবুদ্ধি হয়ে তাকিয়ে থাকে। এনরয়েডগুলো ইতস্তত কিছু সুইচ স্পর্শ করে, হঠাৎ করে তারা সকল যন্ত্রপাতির নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছে।
কী হচ্ছে এখানে?
মূল প্রসেসর কাজ করছে না।
কেন?
নতুন সিগনাল আসছে।
কোথা থেকে আসছে?
এই প্রাণীটি থেকে।
ক্রীনা অবাক হয়ে রয়েড এবং বুদ্ধিমান এনরয়েডগুলোর দিকে তাকিয়ে রইল—তারা নিজেদের ভাষায় কথা বলছে, সে কিছু বুঝতে পারছে না কিন্তু তবুও তাদের বিপর্যস্ত ভাবটুকু ধরতে পারছে। কিন্তু একটা বড় ধরনের সমস্যা হয়েছে। যন্ত্রপাতির নিয়ন্ত্রণটুকু তারা হারিয়ে ফেলেছে।