ক্রীনা অনেক চেষ্টা করেও চোখের পানিকে আটকে রাখতে পারল না। হঠাৎ করে আকুল হয়ে কেঁদে উঠল।
রয়েড এক পা এগিয়ে এসে বলল, তুমি চাইলে আমরা তোমার স্মৃতিকে মুছে দিতে পারি।
আমার এই স্মৃতিটুকুই আছে। সেটাও তোমরা মুছে দিতে চাও?
তুমি কি রুখকে দেখতে চাও?
ক্রীনা চমকে উঠে বলল, কী বললে?
আমি জানতে চাইছি, তুমি কি রুখকে দেখতে চাও?
সে কোথায়?
মহাজাগতিক প্রাণী মেতসিসের ভিতরে এই দরজাটা খুলেছে। এখান দিয়ে তারা কিছু একটা গ্রহণ করে, সেটাকে পরীক্ষা করে তারপর আবার ফিরিয়ে দেয়।
কোথায় ফিরিয়ে দেয়? ক্রীনা আর্তস্বরে চিৎকার করে বলল, কখন ফিরিয়ে দেয়?
এই মেতসিসে ঠিক এরকম আরেকটি দরজা খুলেছে সেদিক দিয়ে ফিরিয়ে দেয়। কখন ফিরিয়ে দেয় সেই প্রশ্নটির উত্তর খুব সোজা নয়। আমরা একটুকরা পাথর দিয়েছিলাম সেটা দুই হাজার বছর রেখে ফেরত পাঠিয়েছে!
দুই হাজার বছর? এটা কী করে সম্ভব? এই মেতসিস তার যাত্রা শুরু করেছে মাত্র। সাত শ বছর আগে।
সম্ভব, আমরা কার্বন ডেটিং করে বের করেছি।
জীবন্ত কাউকে পাঠিয়েছ কখনো?
জীবন্ত প্রাণীকে এরা সাধারণত বিশ থেকে পঁচিশ বছর রাখে।
ক্রীনা হাহাকার করে বলল, বিশ থেকে পঁচিশ বছর?
হ্যাঁ। প্রথম প্রথম জীবন্ত প্রাণীকে তারা ঠিক করে বিশ্লেষণ করতে পারত না। একজন মানুষ ফিরে আসত পরিবর্তিত।
পরিবর্তিত?
হ্যাঁ। মানুষের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ওলটপালট হয়ে যেত। তারা বিকৃত হয়ে ফিরে আসত। বিকৃত এবং মৃত।
ক্রীনা ভয়–পাওয়া–চোখে রয়েডের দিকে তাকিয়ে রইল।
ইদানীং তারা মনে হয় জীবন্ত প্রাণীকে মোটামুটি ঠিকভাবে বিশ্লেষণ করতে পারে, শেষ মানুষটি জীবন্ত ফিরে এসেছে। বৃদ্ধ কিন্তু জীবন্ত।
ক্রীনা হতচকিতের মতো বলল, তার মানে একসময় রুখও ফিরে আসবে? জীবন্ত?
হ্যাঁ। আমার তাই বিশ্বাস।
সেটি কত দিন পরে?
কেউ জানে না। আমাদের এখানে সাথে সাথেই ফিরে আসে। কয়েক মাইক্রোসেকেন্ডের মাঝে, কিন্তু এর মাঝে তার দীর্ঘ সময় পার হয়ে যায়।
কী বলছ তুমি? ক্রীনা চিৎকার করে বলল, কী বলছ?
আমি ঠিকই বলছি।
তার মানে তার মানে–রুখ এর মাঝে মেতসিসে ফিরে এসেছে?
আমি নিশ্চিত।
কোথায় আছে সে? কেমন আছে? বেঁচে আছে?
রয়েড রহস্যময় ভঙ্গি করে হাসল, বলল, তুমি নিজেই দেখবে। চল।
১০. স্বচ্ছ নীলাভ পরদাটি
রুখ স্বচ্ছ নীলাভ পরদাটি স্পর্শ করতেই মনে হল কিছু একটা যেন হঠাৎ করে প্রবল আকর্ষণ করে তাকে টেনে নিল। রুখের মনে হল কেউ তাকে একটি নিঃসীম অতল গহ্বরে ছুঁড়ে দিয়েছে। সে দুই হাত–পা ছড়িয়ে আর্তচিৎকার করে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করে, কিছু একটা ধরার চেষ্টা করে কিন্তু সে কিছুই আঁকড়ে ধরতে পারে না। অতল শূন্যতার মাঝে সে পড়ে যেতে থাকে। তার মনে হতে থাকে যে কোনো মুহূর্তে সে বুঝি কোথায় আছড়ে পড়বে, কিন্তু সে আছড়ে পড়ে না—গভীর শূন্যতায় নিমজ্জিত হতে থাকে।
রুখ চোখ খুলে তাকায়। চারদিকে নিকষ কালো অন্ধকার, মনে হয় আলোর শেষ বিন্দুটিও কেউ যেন শুষে নিয়েছে। সে প্রাণপণে দেখার চেষ্টা করে কিন্তু কোথাও কিছু নেই, কোনো আলো নেই, রূপ নেই। কোনো আকার নেই অবয়ব নেই, কোনো অস্তিত্ব নেই। এটি কি আসলে অন্ধকার? নাকি এটি আলোহীন অন্ধকারহীন এক অস্তিত্ব? রুখের হঠাৎ মনে হয় তার নিশ্চয়ই মৃত্যু হয়েছে। হয়তো এটিই মৃত্যু। যখন কোনো আদি নেই অন্ত নেই শুরু নেই শেষ নেই আলো নেই অন্ধকার নেই শুধু এক অবিচ্ছিন্ন অস্তিত্ব সেটাই হয়তো মৃত্যু।
রুখ সেই আদিহীন অন্তহীন অস্তিত্বে নিজেকে সমর্পণ করে দেয়। তার বুকের মাঝে এক শূন্যতা খেলা করতে থাকে। গভীর বেদনায় কী যেন হাহাকার করে ওঠে। সে নিজেকে ফিসফিস করে বলে, বিদায়।
কিন্তু সেই কথা সে শুনতে পারে না। রুখ আবার চিৎকার করে ওঠে, বিদায়।
এক অমানবিক নৈঃশব্দ্য তাকে ঘিরে থাকে। রুখ নিজেকে স্পর্শ করার চেষ্টা করে কিন্তু সে তার দেহকে খুঁজে পায় না। সে কোথায়? তার চারপাশে রূপ–বর্ণ–গন্ধহীন এক অতিপ্রাকৃত জগৎ। তার চেতনা ছাড়া আর কিছু নেই সেখানে। শুধু তার চেতনা। এটাই কি মৃত্যু?
না এটা মৃত্যু নয়।
কে? কে কথা বলে?
আমি।
আমি কে?
আমি। আমি হচ্ছি আমি।
আমি কোথায়?
তুমি এখানে।
এখানে কোথায়?
এখানে আমার কাছে।
কেন?
আমি দেখতে চাই। বুঝতে চাই।
কী দেখতে চাও?
তোমাকে।
কিন্তু এত অন্ধকার। তুমি কেমন করে দেখবে?
কে বলেছে অন্ধকার?
রুখ অবাক হয়ে তাকাল, সত্যিই কি অন্ধকার? চারদিকে কি হালকা নরম একটা আলো নেই? সমস্ত চেতনা উনখ করে সে তাকাল, দেখল কোমল একটা আলো ছড়িয়ে পড়ছে। কিন্তু শুধুমাত্র সেই হালকা নরম আলো, আর কিছু নেই। শুরু নেই, শেষ নেই, আদি নেই, অন্ত নেই, এক কোমল নরম আলোর বিস্তৃতি। রুখের হঠাৎ মনে হয় আসলে সব মায়া, সব কল্পনা, সব এক অতিপ্রাকৃত স্বপ্ন।
না। এটি স্বপ্ন নয়।
রুখ চমকে উঠল, কে? কে কথা বলে?
আমি।
তুমি কি সত্যি?
তুমি যদি ভাব আমি সত্যি তবে আমি সত্যি।
আমি কি সত্যি?
হ্যাঁ, তুমি সত্যি।
তা হলে আমি নিজেকে দেখতে পাই না কেন? আমার দেহ কই? হাত–পা–চোখ–মুখ কই?
আছে।
কোথায় আছে?
আমার কাছে।
কেন?
কৌতূহল। আমি দেখতে চাই বুঝতে চাই। নতুন রূপ দেখলে আমার কৌতূহল হয়।
তুমি কি একা?
আমি একা। আবার আমি অনেক। একা এবং অনেক।