তুমি যেভাবেই বল ত্রাশিয়ান, আমরা পৃথিবী থেকে মানুষকে ধ্বংস করেছি। পৃথিবীতে এখন মানুষ নেই।
ত্রাশিয়ান জোর গলায় বলল, আপনি আমাকে ক্ষমা করবেন মহামান্য ট্রিটন, আমি আপনার সাথে একমত হতে পারছি না। আমরা পৃথিবী থেকে মানুষকে ধ্বংস করি নি। মানুষ নিজেরা নিজেদের ধ্বংস করেছে।
হ্যাঁ। কিন্তু তারা ধ্বংস হয়েছে আমাদের হাতে।
এটি অবশ্যম্ভাবী ছিল মহামান্য ক্লাউস। একবিংশ শতাব্দীতে মানুষ যখন প্রথমবার টেরাফ্লপ কম্পিউটার তৈরি করেছিল বলা যেতে পারে সেই দিন থেকেই তারা নিজেদের ধ্বংস প্রক্রিয়া শুরু করেছে। আপনার নিশ্চয়ই স্মরণ আছে মহামান্য ক্লাউস, টেরাফ্লপ কম্পিউটার ছিল মানুষের মস্তিষ্কের সমপরিমাণ জটিলতাসম্পন্ন প্রথম কম্পিউটার।
ক্লাউস ট্রিটন তার যান্ত্রিক চক্ষুকে প্রসারিত করে বললেন, হ্যাঁ। আমার স্মরণে আছে। আমি ইতিহাস পড়ে দেখেছি একবিংশ শতাব্দীতে মানুষের কেউ কেউ আশঙ্কা প্রকাশ করেছিল যে একদিন যন্ত্রের কাছে মানুষের পরাজয় হতে পারে।
হ্যাঁ। কিন্তু সেই আশঙ্কাকে কেউ গুরুত্ব দিয়ে নেয় নি। একবিংশ শতাব্দীতে মস্তিষ্কের যান্ত্রিক রূপ তৈরি হলেও তার নির্ভরযোগ্য সফটওয়্যার আসতে আরো এক শতাব্দী সময় লেগেছে। একবার সেটি গড়ে ওঠার পর মানুষের ধ্বংস প্রতিরোধ করার কোনো উপায় ছিল না মহামান্য ক্লাউস। যন্ত্র যেদিন মানুষ থেকে বেশি বুদ্ধিমান হয়েছে সেই দিন থেকে এই পৃথিবীতে মানুষের প্রয়োজন শেষ হয়ে গেছে। মানুষের দেহ বড় ঠুনকো, তাদের মস্তিষ্ক পৃথিবীর সভ্যতার প্রয়োজনের তুলনায় অপর্যাপ্ত।
আমি জানি, ক্লাউস ট্রিটন ক্লান্ত গলায় বললেন, তবুও কোথায় জানি কোথায় জানি একটা অন্যায় ঘটেছে বলে মনে হয়।
ত্রাশিয়ান হা হা করে হেসে বললেন, আমাদের কপোট্রন ঠিক মানুষের অনুকরণে তৈরি হয়েছে, তাই আমরা এখনো হা হা করে হাসি, আমাদের গলার স্বরে দুঃখ–কষ্ট–বেদনার ছাপ পড়ে এবং আমরা ন্যায়–অন্যায় নিয়ে কথা বলি। মানুষের বেলায় ন্যায়–অন্যায়ের প্রশ্ন ছিল, আমাদের তার প্রয়োজন নেই। আমরা মানুষের একক সত্তা থেকে সমষ্টিগত সত্তার দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। পৃথিবীতে যদি একটিমাত্র প্রাণী থাকে তাহলে কি সে ন্যায় কিংবা অন্যায় করতে পারে?
ক্লাউস ট্রিটন বললেন, না। পারে না।
আপনি জানেন মহামান্য ট্রিটন, জীবজগতের সৃষ্টি হয়েছে বিবর্তনে। বিবর্তন খুব ধীর প্রক্রিয়া। শুধু ধীর নয় এটি অত্যন্ত অগোছালো এবং অপরিকল্পিত প্রক্রিয়া। আমরা বিবর্তনে আসি নি, আমাদেরকে তৈরি করা হয়েছে। মানুষের উপরে বিজয়ের প্রথম ধাপটি ছিল। নিজেদেরকে নিজেরা তৈরি করার মাঝে। আমরা প্রত্যেকবার নিজেদেরকে আগের চাইতে অনেক ভালো করে তৈরি করি। বহু হাজার বছর মানুষের মস্তিষ্কের নিউরনের সংখ্যা ছিল দশ বিলিয়ন। আমাদের বর্তমান কপোট্রনেই রয়েছে এক মিলিয়ন ট্রিলিয়ন সেল। পৃথিবীর সকল মানুষের সম্মিলিত বুদ্ধিমত্তা থেকে আমার কিংবা আপনার বুদ্ধিমত্তা অনেক বেশি। মানুষের জন্য দুঃখ অনুভব করে কোনো লাভ নেই মহামান্য ট্রিটন।
তুমি ঠিকই বলেছ ত্রাশিয়ান। ক্লাউস ট্রিটন তার কপোট্রনে পরিমিত শক্তি সঞ্চালন করে বিভিন্ন অনুভূতিগুলোর মাঝে সমন্বয় সাধন করে বললেন, আমি আগামীকাল তোমাদের সবাইকে ডেকেছি। মনে আছে তো?
মনে আছে।
উপস্থিত থেকো।
আপনি বললে নিশ্চয়ই থাকব। তবে
তবে?
আপনারা যে বিষয় নিয়ে আলোচনা করবেন সেখানে আমার আলাদা করে কিছু যোগ করার নেই।
আছে ত্রাশিয়ান। বৈজ্ঞানিক এবং প্রযুক্তির সকল তথ্য আমরা তথ্যকেন্দ্রেই পেয়ে যাই। যে তথ্যটা পাই না সেটা বিজ্ঞান, গণিত বা প্রযুক্তির সমস্যা নয়। সেটা অন্য সমস্যা। তুমি অবশ্যই উপস্থিত থাকবে ত্রাশিয়ান।
যোগাযোগ মডিউলের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। ক্লাউস ট্রিটন এবং ত্রাশিয়ানের এই পুরো কথোপকথনে সময় ব্যয় হয়েছিল তিন দশমিক চার দুই মাইক্রোসেকেন্ড। পৃথিবীচারী এনরয়েডের চিন্তাপদ্ধতি যদি মানুষের অনুকরণে না করা হত সেটি আরো দশ। ভাগ কমিয়ে আনা যেত। মানুষ পৃথিবীর প্রথম বুদ্ধিমান অস্তিত্ব কিন্তু সবচেয়ে দক্ষ অস্তিত্ব নয় পৃথিবীচারী এনরয়েডেরা সেটি মাত্র বুঝতে শুরু করেছে।
০২. আকাশ ছোঁয়া কালো গ্রানাইটের হলঘর
প্রায় আকাশ ছোঁয়া কালো গ্রানাইটের হলঘরটিতে বিজ্ঞান একাডেমির সভা শুরু হয়েছে। হলঘরটি যখন তৈরি করা হয়েছিল তখন সেটি কত বড় করে তৈরি করার প্রয়োজন ছিল কারো জানা ছিল না, এখন বোঝা যাচ্ছে এটি অকারণে অনেক বড় করে তৈরি করা হয়েছে। কালো গ্রানাইটের ছাদ অনেক উঁচু, অল্প কয়টি কলামের উপর ভর করে দাঁড়িয়ে আছে, এনরয়েডের যুগে এটি তৈরি করা এমন কিছু কঠিন ব্যাপার নয় কিন্তু মানুষের যে যুগে এটি তৈরি হয়েছিল তখন নিঃসন্দেহে এটি প্রযুক্তির একটি বড় উদাহরণ ছিল। বিশাল হলঘরে একটি সুদীর্ঘ টেবিলের এক প্রান্তে বসে ক্লাউস ট্রিটন এক ধরনের বিষণ্ণতা অনুভব করেন।
সামনে টেবিলে তাকে ঘিরে সারা পৃথিবীর বিভিন্ন বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তিকেন্দ্রের পরিচালকেরা বসে আছেন। মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক তার যান্ত্রিক গলায় বললেন, যথাযোগ্য সম্মান প্রদর্শন করে বলছি, আমরা যে মহাকাশযানটি তৈরি করতে যাচ্ছি আমাদের প্রযুক্তি সেটি তৈরি করতে এখনো প্রস্তুত নয়।