পিকো হঠাৎ তার জায়গায় সোজা হয়ে দাঁড়াল। তারপর ক্রীনার দিকে এগিয়ে আসতে আসতে, চিৎকার করে বলে, আমি এই মুহূর্তে তোমার মস্তিষ্ক বিদীর্ণ করে দেব, অপটিক নার্ড ছিঁড়ে ফেলে বৈদ্যুতিক তরঙ্গে তোমার শরীর ছিন্নভিন্ন করে দেব। নির্বোধ মেয়ে
রয়েড বলল, অনেক হয়েছে পিকো। তুমি থাম।
পিকো থামার কোনো লক্ষণ দেখাল না, ক্রীনার দিকে এগিয়ে আসতেই লাগল। রয়েড তখন তার হাত তুলে পিকোর দিকে লক্ষ করে একটি প্রচণ্ড বিদ্যুৎ–ঝলক ছুঁড়ে দেয়, মুহূর্তের মাঝে পিকোর পুরো মাথাটি একটা বিস্ফোরণ করে উড়ে যায়। মাথাবিহীন অবস্থায় পিকো দু–এক পা এগিয়ে এসে হঠাৎ করে থেমে যায়, পুরো জিনিসটিকে একটি বিকট রসিকতা বলে মনে হতে থাকে। ফ্যামটো নামের এনরয়েডটি শিস দেবার মতো শব্দ করে বলে, এক শত বিয়াল্লিশ ঘণ্টার মাঝে পিকো দুবার ধ্বংস হল।
রয়েড হাসতে হাসতে বলল, পিকোকে পুনর্বিন্যাস করার সময় এবারে মানবিক অনুভূতি কমিয়ে আনতে হবে।
হ্যাঁ। ফ্যামটো গম্ভীর গলায় বলল, মানুষের সাথে কথা বলার জন্য মানবিক অনুভূতির প্রয়োজন নেই।
রয়েড এবার ঘুরে রুথ এবং ক্রীনার দিকে তাকিয়ে বলল, আমি খুব দুঃখিত তোমাদের সামনে এ–ধরনের একটি দুর্ঘটনা ঘটানোর জন্যে।
রুখ এবং ক্রীনা কোনো কথা বলল না, এক ধরনের আতঙ্ক নিয়ে একবার পিকোর বিধ্বস্ত দেহ এবং একবার রয়েডের দিকে তাকাল। রয়েড একটু সামনে ঝুঁকে বলল, যা বলছিলাম, তোমরা কি এখন অনুমান করতে পার কেন তোমাদের এখানে আনা হয়েছে?
রুখ একবার ক্রীনার দিকে তাকিয়ে একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, এইমাত্র যা ঘটল, তার পুরোটা নিশ্চয়ই সাজানো ঘটনা। তোমরা আমাদেরকে এনেছ বিশেষ প্রয়োজনে।
নিনীষ স্কেলে অষ্টম মাত্রা হিসেবে তোমরা যথেষ্ট বুদ্ধিমান। প্রয়োজনটা কি তোমরা আন্দাজ করতে পার?
না, পারি না।
চেষ্টা কর।
আমাদেরকে তোমরা কোনো কাজে ব্যবহার করবে।
কী কাজে?
রুখ খানিকক্ষণ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে রয়েডের দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর মাথা নেড়ে বলল, তুমি প্রকৃত মানুষ নও, তুমি একটা মানুষের প্রতিচ্ছবি, তোমার দিকে তাকিয়ে আমি কিছু অনুমান করতে পারি না। তবে
তবে কী?
তোমরা যে–কাজে আমাদের ব্যবহার করতে চাও সেটি–সেটি
সেটি?
সেটি নিশ্চয়ই আমাদের জন্যে খুব ভয়ঙ্কর।
রয়েড কয়েক মুহূর্ত নিঃশব্দে রুখ এবং ক্রীনার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, তোমরা মোটামুটি ঠিকই আন্দাজ করেছ। মেতসিস একটা বিচিত্র কক্ষপথে আটকা পড়ে আছে। কোনো একটা বুদ্ধিমান মহাজাগতিক প্রাণী আমাদের সাথে যোগাযোগ করতে চাইছে। তারা আমাদের থেকেও বুদ্ধিমান–তাদের বুদ্ধিমত্তার কাছে তোমার আমার দুজনের বুদ্ধিমত্তাই একই রকম অকিঞ্চিৎকর। তাই
তাই?
খবর নেওয়ার জন্য আমি তোমাদের একজনকে সেই প্রাণীর কাছে পাঠাব।
না– রুখ আর্তচিৎকার করে বলল, না। না–
রয়েড কোনো কথা না বলে স্থিরদৃষ্টিতে দুজনের দিকে তাকিয়ে রইল। ভালবাসাহীন। কঠোর সেই দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে রুখ হঠাৎ শিউরে ওঠে।
০৯. রুখ ক্রীনার চোখের দিকে তাকাল
রুখ ক্রীনার চোখের দিকে তাকাল, ক্রীনা একমুহূর্ত সেদিকে তাকিয়ে থেকে চোখ নামিয়ে নেয়। তার চোখে পানি এসে যাচ্ছিল সেটি সে রুখকে দেখতে দিতে চায় না। রুখ ক্রীনার মুখের উপর থেকে তার কালো চুল সরিয়ে নরম গলায় বলল, আবার দেখা হবে ক্রীনা।
ক্রীনা মাথা নেড়ে বলল, দেখা হবে?
এখানে না হলে অন্য কোথাও।
অন্য কোথাও?
কখনো না কখনো তো বিদায় নিতে হতই। আমরা না–হয় একটু আগেই নিচ্ছি।
ক্রীনা কোনো কথা বলল না, রুখের দিকে একনজর তাকিয়ে আবার চোখ নামিয়ে নেয়।
কত সময় তোমাকে পেয়েছি সেটা তো বড় কথা নয়। তোমাকে পেয়েছি সেটা বড় কথা। রুখ দূর্বলভাবে হেসে বলল, মানুষ হয়ে জন্মালে মনে হয় খানিকটা দুঃখ পেতেই হয়। তাই না?
ক্রীনা মাথা নেড়ে নিচু গলায় বলল, আমি দুঃখিত রুখ। আমি খুব দুঃখিত যে তুমি আর আমি মেতসিসে মানুষ হয়ে জন্মেছি। আমরা যদি হাজার বছর আগে পৃথিবীতে মানুষ হয়ে জন্মাতাম
কিছু আসে–যায় না ক্রীনা। একমুহূর্তের ভালবাসা আর সহস্র বছরের ভালবাসা আসলে একই ব্যাপার। আমাকে বিদায় দাও ক্রীনা
ক্রীনা জোর করে নিজেকে শক্ত করে মুখ তুলে দাঁড়ায়। তাদের ঘিরে মানুষের চেহারায় রয়েড আর বুদ্ধিমান এনরয়েডরা দাঁড়িয়ে আছে, মানুষ থেকে বুদ্ধিমান এই যন্ত্রগুলোকে সে নিজের শোকটুকু বুঝতে দেবে না। সে হাত দিয়ে গভীর ভালবাসায় রুখের মুখমণ্ডল স্পর্শ করে নরম গলায় বলল, বিদায় রুখ। যদি ঈশ্বর বলে কেউ থাকেন তিনি তোমাকে রক্ষা করুন।
রুখ নিচু হয়ে ক্রীনার চুলে নিজের মাথা ডুবিয়ে প্রায় হঠাৎ করে ঘুরে দাঁড়াল, তার সামনে কিছু অমসৃণ পাথরের মাঝখানে আয়নার মতো এক স্বচ্ছ নীলাভ একটি পরদা। মহাজাগতিক প্রাণী মেতসিসের সাথে যোগাযোগের জন্যে এই মহাজাগতিক দরজা সৃষ্টি করেছে। এই স্বচ্ছ নীলাভ পরদার ভিতর দিয়ে রুখকে যেতে হবে। তার অন্য পাশে কী আছে রুখ জানে না। সেখানে তাকে কী করা হবে সেটাও সে জানে না। এক ভয়ঙ্কর অনিশ্চিত জগৎ। রুখ নিজেকে শক্ত করে সামনের দিকে এগিয়ে যায়। নীলাভ স্বচ্ছ পরদার সামনে এসে সে একমূহুর্ত অপেক্ষা করে, মনে হয় সে বুঝি একবার ঘুরে তাকাবে, কিন্তু সে ঘুরে তাকাল না। লম্বা পদক্ষেপে সে নীলাভ স্বচ্ছ পরদার মাঝে প্রবেশ করল, মনে হল কিছু একটা যেন হঠাৎ করে তাকে গ্রাস করে নিল, টেনে ভিতরে নিয়ে গেল। স্বচ্ছ নীলাভ পরদায় একমুহূর্তের জন্য একটা আলোড়নের সৃষ্টি হয়, বারকয়েক কেঁপে উঠে সেটা আবার স্থির হয়ে যায়।