উপস্থিত সবাই আর্তচিৎকার করে ওঠে, রুখ হাত তুলে তাদের থামিয়ে দিয়ে বলল, আমি আগেই বলেছি, তোমাদের কাছে যত অবিশ্বাস্য মনে হোক তোমাদের আমার কথা বিশ্বাস করতে হবে। এই মুহূর্তে ক্রীনা এবং রুহান ঠিক এ রকমভাবে আরো স্বেচ্ছাসেবীদের ঠিক একই কথা বলছে। আমরা আগে থেকে এটা সবাইকে বলতে পারি নি, শেষ মুহূর্তের জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হয়েছে। তোমরা কোনো প্রশ্ন করবে না–আমি যা বলছি তোমরা যন্ত্রের মতো অক্ষরে অক্ষরে সেটা পালন করবে।
রুখ একটা নিশ্বাস নিয়ে বলল, ঘরের ঐ কোনায় বাক্সের মাঝে দেখ মাইক্রো অক্সিজেন সিলিন্ডার এবং মাস্ক রয়েছে। তোমরা নিজেরা সেটা পরে নাও। বাক্সের মাঝে তোমাদের সবার নাম লেখা আছে। তোমাদের সেই নাম এবং লিস্ট দেখে মানববসতির সবার বাসায় এই অক্সিজেন সিলিন্ডার এবং মাস্ক পৌঁছে দিতে হবে। কে কোথায় যাবে সব লিখে দেওয়া আছে। সবাইকে বলতে হবে কোনো অবস্থাতেই কেউ যেন আগামী এক ঘণ্টা তাদের বাসার বাতাসে নিশ্বাস না নেয়। কোনো অবস্থাতেই না–
সোনালি চুলের একজন তরুণী ভয়–পাওয়া–গলায় বলল, কিন্তু
কোনো প্রশ্ন নয়। আমাদের হাতে সময় নেই। মনে রেখো গোপনীয়তার জন্য আমরা কোনো ধরনের ইলেকট্রনিক যোগাযোগব্যবস্থা ব্যবহার করতে পারব না! যাও।
পঞ্চাশ জন হতবুদ্ধি তরুণ–তরুণী ঘরের কোনায় ছুটে গেল। নিজের নাম লেখা বাক্স খুলে অক্সিজেন সিলিন্ডারগুলো হাতে নিয়ে তারা নিজেদের মাঝে উত্তেজিত গলায় কথা বলতে বলতে রাতের অন্ধকারে বের হয়ে যায়। রুখ একটু পরেই তাদের ভাসমান যানের ইঞ্জিনের চাপা শব্দ শুনতে পায়। এই মুহূর্তে মানববসতির অন্য অংশেও আরো তরুণ–তরুণীরা এইভাবে ছুটে বের হয়ে গেছে। তাদের হাতে মিনিট পনের সময় আছে। রুথ তার বাসা পরীক্ষা করে বাতাস পরিবহনের কেন্দ্রে কার্বন মনোঅক্সাইডের ছোট সিলিন্ডারটি আবিষ্কার করেছে। নিয়ন্ত্রণ–কেন্দ্র থেকে নির্দেশ পাবার পর স্বয়ংক্রিয় ভালবটি খুলে ঘরের বাতাসে মেরে ফেলার মতো প্রয়োজনীয় কার্বন মনোঅক্সাইড গ্যাস প্রবেশ করাতে কমপক্ষে পনের মিনিট সময় নেবে। তাদের হাতে তাই পনের মিনিট সময় রয়েছে, তার বেশি নয়।
রুখ তার নিও পলিমারের জ্যাকেটের পকেট থেকে তার নিজের ছোট অক্সিজেন। সিলিন্ডারটি বের করে নেয়। ঘরের কোনায় যোগাযোগমডিউলে একটা লাল বাতি জ্বলছে এবং নিভছে, বাইরে সাইরেনের তীক্ষ্ণ শব্দ উঠছে এবং নামছে, বিচিত্র এই পরিবেশের মাঝে এক ধরনের অশুভ আতঙ্ক লুকিয়ে আছে, অনেক চেষ্টা করেও রুখ সেটা ঝেড়ে ফেলতে পারে না।
.
খুব ধীরে ধীরে দিগন্তের কাছাকাছি চৌম্বকীয় ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রিত ফিউসান দিয়ে সূর্য তৈরি করা হচ্ছে। ভোরের প্রথম আলোতে সবকিছু কেমন যেন অতিপ্রাকৃত দেখায়। মানববসতির প্রায় সবাই খোলা মাঠে উপস্থিত হয়েছে। অনেকের মুখে এখনো অক্সিজেন মাস্ক লাগানো রয়েছে, সেটি খুলে ফেলা নিরাপদ কি না এখনো পুরোপুরি নিশ্চিত হতে পারছে না।
রুখ তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা রুহানকে জিজ্ঞেস করল, কত জনকে বাঁচানো যায় নি?
শেষ হিসাব অনুযায়ী এগার জন। এর মাঝে চার জনের কাছে সময়মতো খবর পৌঁছানো যায় নি–যাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে নিজেই দুর্ঘটনা ঘটিয়েছে। বাকিদের মাঝে চার জন নিকিতা–পরিবারের। তারা আমাদের কথা বিশ্বাস করলেও স্বেচ্ছামৃত্যু বেছে নিয়েছে।
কেন?
তাদের ধারণা বুদ্ধিমান এনরয়েড যদি সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে আমাদের মৃত্যুবরণ করা উচিত তা হলে সেটাই মেনে নিতে হবে। সেটাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ।
রুখ রুহানের দিকে তাকিয়ে বলল, তোমার কী মনে হয় রুহান?
আমার? রুহান একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, আমি জানি না রুখ, তবে সত্যি কথা বলতে কী আমার ভয় করছে–যাকে বলে সত্যিকারের ভয়। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে হয়তো নিকিতা–পরিবারই বুদ্ধিমান–আমরাই নির্বোধ
হতে পারে। রুখ মাথা নেড়ে বলল, কিন্তু আমরা তো মানুষ। মানুষ কখনো শেষ চেষ্টা না করে ছাড়ে না। বুদ্ধিমান এনরয়েডরা সত্যিই যদি বুদ্ধিমান হয়ে থাকে তারাও সেটা জানে।
রুহান একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, ক্রীনা কোথায়?
আসছে। যারা মারা গেছে মনে হয় তাদের মৃতদেহের ব্যবস্থা করে আসছে।
ও।
ক্রীনা না থাকলে আমাদের বেশ অসুবিধে হত।
হ্যাঁ। ক্রীনা চমৎকার একটি মেয়ে। যত বড় বিপদই হোক শেষ পর্যন্ত মাথা ঠাণ্ডা রাখে। এই বিপদটি কীভাবে সামলে নিতে হবে পুরোটা কী চমৎকারভাবে পরিকল্পনা করেছে। দেখেছ!
রুখ একটা নিশ্বাস ফেলে, ক্রীনা সত্যিই চমৎকার একটি মেয়ে। বুকের গভীরে তার জন্য সে যে ব্যাকুলতা অনুভব করে কখনো কি সেটি তাকে বলতে পারবে? কেন সে সহস্র বছর আগে মানুষের সাদামাঠা পৃথিবীতে সাদামাটা একজন মানুষ হয়ে জন্ম নিল না? রুখ অন্যমনস্কভাবে উপরে তাকায়, ঠিক তখন বহুদূরে ছোট ছোট বিন্দুর মতো অনেকগুলো স্কাউটশিপ দেখতে পেল। রুখ একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে, বিন্দুগুলো ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে, সেগুলো এদিকেই এগিয়ে আসছে। সে রুহানের দিকে তাকাল, নিচু গলায় বলল, রুহান, ওরা আসছে।
স্কাউটশিপগুলো সমবেত সবার মাথার উপর দিয়ে উড়ে গিয়ে কাছাকাছি এক জায়গায় নামল। স্কাউটশিপের গোলাকার দরজা খুলে যায় এবং ভিতর থেকে বেশকিছু খাটো এবং বিদঘুঁটে পরিবহন রোবট নেমে এল। রোবটগুলো কাছাকাছি এসে থেমে গেল, সেগুলোকে কেমন যেন বিভ্রান্ত দেখাচ্ছে। কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকা একটি রোবট খনখনে গলায় বলল, তোমরা জীবিত। আমাদের বলা হয়েছে তোমরা মৃত।