ক্রীনা–_ রুখ হঠাৎ চিৎকার করে উঠল, ক্রীনা!
কী?
তুমি ঠিকই সন্দেহ করেছ। এখন আমার মনে পড়েছে।
মনে পড়েছে?
হ্যাঁ। মনে আছে আমি বলেছিলাম–বিশাল হলঘরে সারি সারি মানুষ ঝুলিয়ে রাখা আছে? সবাই ঘুমিয়ে আছে। তারা–তারা–
তারা কারা?
তারা আমরা। আমি, তুমি, রুহান সবাই। সবাই।
আমরা?
হ্যাঁ। একই জিনেটিক কোড দিয়ে তৈরি একই মানুষ। রুখ জোরে জোরে নিশ্বাস নিতে থাকে, তার মুখে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে ওঠে, সে ভয়ার্ত চোখে একবার রুহান আর ক্রীনার দিকে তাকাল, তারপর আর্ত গলায় বলল, একদিন আমরা সবাই মারা যাব। সবাই একসাথে। তখন অন্য আমাদের জাগিয়ে তোলা হবে, তারা এসে এখানে থাকবে। যেভাবে একদিন আমরা এসেছি। তার আগে অন্য আমরা এসেছি। তার আগে অন্য আমরা–তার আগে–
রুখ হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে নিজের মাথা ধরে আর্তচিৎকার করে ওঠে, তার শরীর থরথর করে কাঁপতে থাকে, সে তার নিজের পায়ের উপর আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। হাঁটু ভেঙে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।
ক্রীনা রুখের কাছে ছুটে যায়, তার মাথাটি নিজের কোলের উপরে টেনে নিয়ে তার উপর ঝুঁকে পড়ে। চোখের পাতা টেনে তার চোখের পিউপিলের দিকে তাকাল, হৃৎস্পন্দন শুনল তারপর ঘুরে রুহানের দিকে তাকিয়ে বলল, হঠাৎ করে মাথার উপর চাপ পড়েছে, তাই অজ্ঞান হয়ে গেছে। আমার মনে হয় ভয়ের কিছু নেই। তবে–
তবে কী?
আমি জানি না বুদ্ধিমান এনরয়েডরা আমাদের কত তীক্ষ্ণভাবে পর্যবেক্ষণ করে। যদি খুব তীক্ষ্ণভাবে পর্যবেক্ষণ করে তা হলে–
তা হলে?
তা হলে খুব শিগগিরই আমাদের দিন শেষ হয়ে আসবে রুহান।
রুহান কোনো কথা না বলে ক্রীনার দিকে তাকিয়ে রইল।
০৭. তীক্ষ্ণ স্বরে সাইরেন বেজে ওঠে
ভোররাতে হঠাৎ তীক্ষ্ণ স্বরে সাইরেন বেজে ওঠে। রুখ ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসল, সাইরেনের তীক্ষ্ণ স্বরের ওঠানামার মাঝে কেমন জানি একটি অশুভ ইঙ্গিত লুকিয়ে থাকে। রুখ জানে এই অশুভ ইঙ্গিতটি কী। এই ভোররাতে মানববসতির প্রায় দেড় হাজার মানুষকে হত্যা করা হবে। সম্ভবত হত্যা শব্দটি এখানে ব্যবহার করার কথা নয়–মানুষ কিংবা মানুষের সমপর্যায়ের অস্তিত্ব একে অপরকে হত্যা করে। বুদ্ধিমত্তায় অনেক উপরের একটি অস্তিত্ব নিচু অস্তিত্বকে অপসারণ করে। কাজেই এটি হত্যা নয় এটি অপসারণ। ইতঃপূর্বে অসংখ্যবার এই ঘটনা ঘটেছে। এটি প্রায় রুটিন একটি ব্যাপার।
রুখ তার বিছানা থেকে নেমে এল–এই ক্ষুদ্র সাধারণ এবং রুটিন ঘটনাকে তারা ঘটতে দেবে না, তারপর কী হবে তারা জানে না কিন্তু এই মুহূর্তে সেটি তারা ঘটতে দেবে না। রুখ যোগাযোগ–মডিউলটি স্পর্শ করে সেটি চালু করে দেয়। মাথায় সাদাকালো চুলের মধ্যবয়স্ক একজন গম্ভীর ধরনের মানুষ যোগাযোগ–মডিউলে কথা বলছে–গুরুত্বপূর্ণ কোনো ঘটনা বলতে হলে এই ধরনের চেহারার একটি চরিত্র সৃষ্টি করা হয়। রুখ হলোগ্রাফিক স্ক্রিনে মধ্যবয়স্ক মানুষটির দিকে তাকিয়ে রইল, এত জীবন্ত একটি মানুষ আসলে কোনো একটি যন্ত্রের একটি কৌশলী প্রোগ্রাম, দেখে বিশ্বাস হয় না। মধ্যবয়স্ক মানুষটি সোজাসুজি রুখের দিকে তাকিয়ে বলল, মানববসতির সদস্যরা, এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘোষণা অনুগ্রহ করে সবাই মনোযোগ দিয়ে শোন। মেতসিসের বায়ুমণ্ডলের পরিশোধন–কেন্দ্র সাময়িকভাবে বন্ধ রাখতে হবে, বাতাসের চাপ আশঙ্কাজনকভাবে কমে যাবে। বাতাসে অক্সিজেনের পরিমাণ প্রয়োজন থেকে একশত চল্লিশ গুণ কমে যাবে–আমি আবার বলছি, একশত চল্লিশ গুণ কমে যাবে। শুধু তাই নয় পরিশোধন–কেন্দ্র বন্ধ থাকায় বাতাসে কার্বন মনোঅক্সাইড, ফসজিন এবং হাইড্রোজেন সায়নাইড গ্যাস সাময়িকভাবে বৃদ্ধি পাবে, আমি আবার বলছি, বাতাসে কার্বন মনোঅক্সাইড, ফসজিন এবং হাইড্রোজেন সায়নাইড গ্যাস সাময়িকভাবে বৃদ্ধি পাবে। কাজেই, আমার প্রিয় মানবসদস্যরা–আমি তোমাদের নিরাপত্তার জন্যে বলছি পরবর্তী ঘোষণা না দেওয়া পর্যন্ত তোমরা কোনো অবস্থাতেই তোমাদের বাসগৃহ থেকে বের হবে না। আমি আবার বলছি, কোনো অবস্থাতেই তোমাদের বাসগৃহ থেকে বের হবে না। তোমাদের বাসগৃহে বিশুদ্ধ পরিমিত এবং প্রয়োজনীয় বাতাস সরবরাহ করা হবে। কাজেই এই মুহূর্তে তোমাদের বাসগৃহের দরজা এবং জানালা বায়ু–নিরোধক করে নাও। আমি আবার বলছি, এই মুহূর্তে তোমাদের বাসার দরজা এবং জানালা বায়ু নিরোধক করে নাও। আমি আবার বলছি, তোমরা এই মুহূর্তে তোমাদের বাসার দরজা এবং জানালা বায়ু–নিরোধক করে নাও। আমি আবার বলছি…
রুখ হাত দিয়ে স্পর্শ করে যোগাযোগমডিউলটি বন্ধ করে ঘর থেকে বের হয়ে এল। হাতে খুব বেশি সময় নেই।
.
বড় হলঘরটিতে জনাপঞ্চাশেক তরুণ এবং তরুণী উদ্বিগ্ন মুখে অপেক্ষা করছে। রুখ প্রবেশ করার সাথে সাথে তরুণ এবং তরুণীরা তার কাছে ছুটে এল। কমবয়সী একজন উদ্বিগ্ন মুখে বলল, রুখ, আমি বুঝতে পারছি না কী হচ্ছে। তুমি বলেছিলে
রুখ হাত তুলে বলল, আমাদের হাতে নষ্ট করার মতো একটি মুহূর্তও নেই। তোমরা কোনো প্রশ্ন করবে না। আমি যা বলব তোমাদের কাছে অবিশ্বাস্য মনে হলেও তোমাদের। সেটা বিশ্বাস করতে হবে। আমরা এখন ভয়ঙ্কর একটি বিপদের মুখোমুখি এসেছি। আগামী এক ঘন্টার মাঝে এই মানববসতির সকল মানুষকে হত্যা করা হবে।