.
গভীর রাতে রুহানকে ঘুম থেকে ডেকে তোলা হল, রুহান যেটুকু অবাক হল তার থেকে অনেক বেশি ভয় পেয়ে গেল। ফ্যাকাসে মুখে রুখ আর ক্রীনার দিকে তাকিয়ে বলল, কী হয়েছে?
না, রুহান কিছু হয় নি। ক্রীনা হেসে বলল, এমনি এসেছি।
রুহান ভুরু কুঁচকে বলল, এমনি কেউ এত রাতে আসে না। বল কী হয়েছে?
রুখ একটু অপরাধীর মতো বলল, আমি আসলে এত রাতে আসতে চাই নি কিন্তু ক্রীনা। বলল দেরি করে লাভ নেই।
কী ব্যাপারে দেরি করে লাভ নেই?
আমি বলছি, শোন। ক্রীনা তখন অল্প কথায় পুরো ব্যাপারটি রুহানকে বুঝিয়ে বলে। রুখ আশা করছিল রুহান পুরোটুকু শুনে ক্রীনার আশঙ্কাকে হেসে উড়িয়ে দেবে। কিন্তু সে উড়িয়ে দিল না, খুব চিন্তিত মুখে রুখের দিকে তাকিয়ে রইল।
ক্রীনা বলল, আমরা তোমার কাছে এসেছি রুখের মায়ের কথা জানতে। রুখের মা কি কখনো বিশাল কোনো হলঘরে গিয়ে–
না। রুহান মাথা নেড়ে বলল, আমাদের মানববসতিতে কোনো বিশাল হলঘর নেই। রুখের মা কখনো কিছু দেখে ভয় পায় নি–আমি জানি। রুখের মা–বাবা দুজনকেই আমি ভালো করে জানতাম। রুখের বাবা যখন মারা যায় আমি তার খুব কাছে ছিলাম। অনেকদিন আগের ঘটনা কিন্তু আমার কাছে মনে হয় মাত্র সেদিন–
ক্রীনা মাথা নাড়ল, স্মৃতি খুব সহজে প্রতারণা করতে পারে।
হ্যাঁ। রুহান মাথা নাড়ল, যে–জিনিসটা মনে রাখা দরকার সেটা মনে থাকে না কিন্তু খুব অপ্রয়োজনীয় একটা জিনিস স্পষ্ট মনে থাকে।
রুখ দুর্বলভাবে হেসে বলল, আমার জন্যে পুরো ব্যাপারটি আরো ভয়ঙ্কর। বুদ্ধিমান এনরয়েডরা সম্ভবত আমার স্মৃতিকে ওলটপালট করে দিয়েছে। এখন কোনটা সত্যি আর কোনটা মিথ্যা আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি না।
ক্রীনা কোনো কথা না বলে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে রুখের দিকে তাকিয়ে রইল। রুখ বলল, কী হল তুমি আমার দিকে এভাবে তাকিয়ে আছ কেন?
তুমি এইমাত্র কী বললে?
বলেছি তুমি এভাবে তাকিয়ে আছ কেন?
না, তার আগে।
রুখ একটু অবাক হয়ে বলল, তার আগে বলেছি, আমার স্মৃতির কোনটা সত্যি কোনটা মিথ্যা আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি না।
ক্রীনা হঠাৎ ঘুরে রুহানের দিকে তাকাল, রুহান তুমি কি সত্যি বলতে পারবে তোমার কোন স্মৃতিটি সত্যি–কোনটি মিথ্যা?
রুহান হতচকিতের মতো ক্রীনার দিকে তাকিয়ে রইল, খানিকক্ষণ পর একটু হেসে বলল, স্মৃতি তো মিথ্যা হতে পারে না।
কিন্তু রুহান তুমি জান আমাদের বুদ্ধিমত্তা নিনীষ স্কেলে মাত্র আট। বুদ্ধিমান এনরয়েডরা আমাদের যেভাবে ইচ্ছে সেভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। আমাদের স্মৃতিতে যা ইচ্ছে তা প্রবেশ করাতে পারে। আমাদের ভয়ঙ্কর স্মৃতি মুছে সেখানে আনন্দের স্মৃতি প্রবেশ করিয়ে দিতে পারে। আনন্দের স্মৃতি মুছে সেখানে ভয়ঙ্কর স্মৃতি প্রবেশ করাতে পারে।
কিন্তু কেন? কী লাভ?
আমি জানি না। হয়তো হয়তো
হয়তো কী? ক্রীনা কোনো কথা না বলে চুপ করে রইল।
রুহান কিছুক্ষণ ক্রীনার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, তুমি বলতে চাইছ আমাদের সব স্মৃতি সত্যি নয়?
না। আমি বলতে চাইছি কেউ যদি আমাদের স্মৃতিকে নিয়ে খেলা করে আমরা সেটা জানব না। জানার কোনো উপায় নেই।
রুখ খানিকক্ষণ ক্রীনার দিকে তাকিয়ে থাকে। তার মনে হতে থাকে ঠিক এই ধরনের একটা কথা সে আগে কখনো কোথাও শুনেছে–কিন্তু ঠিক কোথায় সে মনে করতে পারে না।
রুহান মাথা নেড়ে বলল, আমরা ইচ্ছা করলেই তো কিছু একটা নিয়ে সন্দেহ করতে পারি। পদার্থবিজ্ঞানের সূত্র নিয়ে সন্দেহ করতে পারি, বলতে পারি আলোর গতিবেগ পরিবর্তনশীল। কিংবা বলতে পারি আমাদের অস্তিত্ব মিথ্যা –এটা আসলে একটা বিশাল গুবরে পোকার স্বপ্ন–কিন্তু সবকিছুর তো একটা ভিত্তি থাকতে হয়। ভিত্তিহীন সন্দেহ তো কোনো কাজে আসে না। আমাদের স্মৃতি মিথ্যা এটা নিয়ে সন্দেহ করার মতো কোনো ভিত্তি আছে?
ক্রীনা মাথা নাড়ল, আছে।
রুখ এবং রুহান দুজনেই ঘুরে ক্রীনার দিকে তাকাল, আছে?
হ্যাঁ।
সেটা কী?
ক্রীনা একটা বড় নিশ্বাস নিয়ে বলল, আমাদের এই মানুষের বসতিতে কত জন মানুষ রয়েছে?
রুহান বলল, হাজার দেড়েক।
যদি কোনো বসতিতে হাজার দেড়েক মানুষ থাকে তুমি আশা করবে তার মাঝে সকল বয়সের মানুষ থাকবে। শিশু থাকবে, কিশোর–কিশোরী থাকবে, তরুণ–তরুণী থাকবে, যুবক–যুবতী, মধ্যবয়স্ক এবং বৃদ্ধ–বৃদ্ধাও থাকবে। আমাদের বসতিতে কোনো শিশু নেই, কোনো বৃদ্ধ নেই।
রুহান একটু অবাক হয়ে ক্রীনার দিকে তাকাল, ভুরু কুঁচকে বলল, তুমি কী বলছ ক্রীনা? বসতিতে যারা শিশু ছিল তারা বড় হয়ে গেছে, যারা বৃদ্ধ ছিল তারা মারা গেছে। আমার স্পষ্ট মনে আছে তোমার জন্ম হল–।
ক্রীনা মাথা নাড়ল, না, তোমার কী মনে আছে সেটা আমি বিশ্বাস করি না।
তুমি বলতে চাইছ।
আমি বলতে চাইছি হয়তো তুমি অতীতে যেটা দেখেছ সেটা কাল্পনিক স্মৃতি। এখন, এই মুহূর্তে যেটা দেখছি শুধু সেটাই আমরা বিশ্বাস করতে পারি। এই মুহূর্তে যেটা দেখছি সেটা অস্বাভাবিক–সেখানে কোনো শিশু নেই, বৃদ্ধ নেই কোনো জন্ম নেই কোনো মৃত্যু নেই। তাই আমি সন্দেহ করছি হয়তো এটাই মেতসিস। মানববসতিতে কিছু মানুষ থাকে–একসময় তাদের সরিয়ে দিয়ে অন্য মানুষেরা আসে। তাদের মাঝে একটা স্মৃতি দিয়ে দেওয়া হয় যেন তারা অনেকদিন থেকে বেঁচে আছে। আসলে এখানে সবাই ক্ষণস্থায়ী।