রুহান মৃদু হেসে বলল, রুখ, তোমার জ্ঞানগম্ভীর আলোচনার জন্য এখন কেউ প্রস্তুত নয়। উত্তেজক পানীয় সবার নিউরনে এখন আলোড়ন সৃষ্টি করছে। কঠিন একটা বক্তৃতা দিয়ে সবাইকে তাড়িয়ে না দিয়ে তুমি বরং আমাদের একটি গান শোনাও।
রুখ হেসে ফেলল, বলল, ঠিকই বলেছ। কিন্তু আমি যদি গান গাই সম্ভবত সবাই আরো দ্রুত পালিয়ে যাবে।
রুহান বলল, দেখই না চেষ্টা করে!
টেবিলের নিচে থেকে বাদ্যযন্ত্র বের করে আনা হল, তাল লয় এবং মাত্রার পরিমাপ ঠিক করে কিছু মডিউল নিয়ন্ত্রণ করা হল, একটি–দুটি সুর পরীক্ষা করা হল এবং রুখ হাততালি দিয়ে গান গাইতে শুরু করল। তার ভরাট গলার স্বর সারা হলঘরে গমগম করতে থাকে– উপস্থিত সবাই হাততালি দিয়ে তার সাথে তাল মিলাতে শুরু করে।
গানের কথাগুলো বহু পুরোনো। পৃথিবী ছেড়ে মানবশিশু যাচ্ছে মহাকাশে অজানার উদ্দেশে, সেখানে কি নীল আকাশ আছে? সাগরের ঢেউ আছে? বাতাসের ক্রন্দন আছে? সেই শিশু কি পৃথিবীর স্মৃতি ছড়িয়ে দেবে অনাগত ভবিষ্যতে? মানুষের ভালবাসা কি বেঁচে থাকবে মানুষের হৃদয়ে?
গানের কথা শুনতে শুনতে ক্রীনার চোখে হঠাৎ পানি এসে যায়। সে সাবধানে তার নিও পলিমারের কোনা দিয়ে চোখ মুছে ফেলে।
.
যে হলঘরটি কিছুক্ষণ আগেই অসংখ্য মানুষের আনন্দোল্লাসে ভরপুর ছিল এখন সেখানে কেউ নেই–এলোমেলো চেয়ার, অবিন্যস্ত টেবিল, পরিত্যক্ত পানীয়ের গ্লাস সবকিছু মিলিয়ে হলঘরটিতে একধরনের বিষণ্ণতা ছড়িয়ে আছে। হলঘরের মাঝামাঝি বিশাল টেবিলের এক কোনায় রুখ দুই হাতে তার মাথা ধরে বসে আছে, তার খুব কাছে ক্রীনা দাঁড়িয়ে ক্রীনার চোখেমুখে একধরনের চাপা অস্থিরতা। সে রুখের মাথায় হাত রেখে বলল, রুখ। তোমার কী হয়েছে?
রুখ মাথা তুলে ক্রীনার দিকে তাকাল, বলল, আমি জানি না।
তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তুমি কিছু একটা নিয়ে খুব ভয় পাচ্ছ।
হ্যাঁ। কিন্তু সেটা কী আমি জানি না।
ক্রীনা চিন্তিত মুখে বলল, বুদ্ধিমান এনরয়েডের ওখানে কী হয়েছিল মনে করার চেষ্টা কর।
সেটা তো তোমাকে বলেছি–
ক্রীনা মাথা নেড়ে বলল, আমাকে যেটা বলেছ সেটা তোমার স্মৃতিতে বাচিয়ে রাখা হয়েছে। কিন্তু নিশ্চয়ই কিছু একটা তোমার স্মৃতি থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে কিছু একটা তোমার স্মৃতিতে জোর করে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। মানুষের মস্তিষ্ক যেভাবে কাজ করে সেখানে এটা খুব সহজ নয়– সবসময়েই অন্য কোনো স্মৃতিতে তার প্রভাব পড়ে। তুমি মনে করার চেষ্টা কর–ভেবে দেখ, কোনো ধরনের অসঙ্গতি কোনো ধরনের অস্বাভাবিকতা তোমার চোখে পড়েছে কি না।
না। রুখ মাথা নেড়ে বলল, আমি কোনো ধরনের অসঙ্গতি মনে করতে পারছি না। তবে
তবে?
তবে যতবার আমি মানুষের বেঁচে থাকা নিয়ে ভাবি ততবার মনে হয় কী যেন হিসাব মিলছে না।
হিসাব মিলছে না?
না। মনে হয় বেঁচে থাকাটা আসলে–আসলে রুখ হঠাৎ কেমন যেন অসহায় ভঙ্গিতে হাল ছেড়ে দিয়ে বলল, আমি জানি না।
ক্রীনা চিন্তিত মুখে বলল, আমার কী মনে হয় জান?
কী?
বুদ্ধিমান এনরয়েডদের ওখানে গিয়ে তুমি কিছু একটা দেখেছ বা কিছু একটা জেনেছ। সেটার সাথে মানুষের বেঁচে থাকার খুব গভীর একটা সম্পর্ক আছে। সেটা নিশ্চয়ই খুব ভয়ঙ্কর একটা তথ্য–সেটা তোমার মস্তিষ্ক থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে কিন্তু তোমার অবচেতন মনে এখনো তার ছাপ রয়ে গেছে–সে জন্য তুমি এরকম অস্থির হয়ে ছটফট করছ।
রুখ কেমন যেন ক্লান্ত ভঙ্গিতে ক্রীনার দিকে তাকাল। একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, তোমার তাই মনে হয়?
হ্যাঁ। চেষ্টা কর মনে করতে। তোমার মস্তিষ্কে তথ্যটা আছে। ক্রীনা রুখের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, আমি জানি–তুমি একবার চেষ্টা করে দেখ।
রুখ দুই হাতে মাথা রেখে কয়েক মুহূর্ত চোখ বন্ধ করে রইল, তারপর অসহায় ভঙ্গিতে বলল, না, কিছু মনে করতে পারছি না। শুধু–
ক্রীনা উৎসুক মুখে বলল, শুধু কী?
শুধু কেন জানি আমার মায়ের কথা মনে পড়ছে
তোমার মায়ের কথা? তোমার মা তো অনেক আগে মারা গেছেন।
আমি জানি।
তোমার মায়ের কথা কী মনে পড়ছে
মনে হচ্ছে আমি যেন আমার মায়ের সাথে যাচ্ছি। মা একটা বিশাল হলঘরের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। হলঘরের দরজা খুলে ভয় পেয়ে চিৎকার করতে শুরু করলেন।
কী দেখে ভয় পেয়েছিলেন?
মানুষ।
মানুষ? কী রকম মানুষ?
রুখ আবার খানিকক্ষণ চিন্তা করে মাথা নেড়ে বলল, না, মনে করতে পারছি না।
মানুষেরা কি মৃত না জীবিত?
মনে হয় জীবিত মনে হয় ঘুমিয়ে আছে।
ঘুমিয়ে আছে?
হ্যা তাদেরকে ঝুলিয়ে রাখা আছে। তারা একসময় জেগে উঠবে তখন ভয়ঙ্কর একটা বিপদ হবে। ভয়ঙ্কর ভয়ঙ্কর বিপদ।
ক্রীনা অবাক হয়ে রুখের দিকে তাকিয়ে রইল। রুখ দুর্বলভাবে হেসে বলল, নিশ্চয়ই কোনো একটা দুঃস্বপ্ন দেখেছি। তাই না?
হয়তো দুঃস্বপ্ন। হয়তো দুঃস্বপ্ন নয়, হয়তো সত্যি। কিন্তু আমরা তো তার ঝুঁকি নিতে পারি না।
তুমি কী করতে চাও?
চল বের হই। যারা বয়স্ক যারা তোমার মাকে দেখেছে তাদের সাথে কথা বলে আসি।
কী নিয়ে কথা বলবে?
সত্যি সত্যি তোমার মা কি কখনো তোমাকে নিয়ে কোথাও গিয়ে ভয় পেয়েছিলেন? সেটা নিয়ে কি কারো সাথে কথা বলেছিলেন?
রুখ একটু অবাক হয়ে বলল, তাতে কী লাভ?।
জানি না। কিন্তু আমার মনে হয় দেরি করে লাভ নেই। সত্যি যদি তুমি বুদ্ধিমান। এনরয়েড থেকে গোপন কোনো তথ্য এনে থাক–সেটা আমাদের জানা দরকার।