সেটি কীভাবে সম্ভব?
এনরয়েডটি হেসে ফেলল, বলল, জানি না।
০৬. হলঘরটিতে মানুষের বসতি
হলঘরটিতে মানুষের বসতির প্রায় সবই এসেছে। খাওয়ার পর আজকে বিশেষ পানীয় সরবরাহ করা হয়েছে, পানীয়তে কয়েক মাত্রা উত্তেজক এনজাইম ছিল তাই যারা উপস্থিত আছে তাদের সবাই হইচই করছে, অল্পতেই হেসে গড়াগড়ি খাচ্ছে বা আনন্দে চ্যাঁচামেচি করছে। হইচইয়ের মাত্রা যখন একটু বাড়াবাড়ি পর্যায়ে পৌঁছে গেল তখন রুহান তার পানীয়ের গ্লাস টেবিলে রেখে উঠে দাঁড়াল, সাধারণত এরকম পরিস্থিতিতে সবাই শান্ত হয়ে যায়, যিনি দাঁড়িয়ে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন তার কী বলার আছে শোনার জন্য সবাই খানিকটা সময় দেয়। আজকে তার কোনো সম্ভাবনা দেখা গেল না। তাই রুহানকে টেবিলে কয়েকবার থাবা দিয়ে শব্দ করে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে হল, যখন হইচই একটু কমে এল তখন রুহান উচ্চৈঃস্বরে বলল, প্রিয় মানববসতির সদস্যরা, সবাইকে আন্তরিক শুভেচ্ছা।
এটি অত্যন্ত সাদামাঠা সম্ভাষণ কিন্তু উত্তেজক এনজাইমের কল্যাণে সবার কাছে এই সম্ভাষণটিকেই এত হৃদয়গ্রাহী মনে হল যে সবাই চিৎকার করে হাত নেড়ে প্রত্যুত্তর দিল।
তোমরা জান–রুহান গলা উচিয়ে বলতে চেষ্টা করে, আজকে আমরা এখানে একটি বিশেষ কারণে উপস্থিত হয়েছি। আমাদের মানববসতির উন্নয়ন পরিষদের নবীন সদস্য রুখ আমাদের মাঝে ফিরে এসেছে। রুহানকে এই সময় একটু থামতে হল কারণ। উপস্থিত সবাই রুখকে সম্ভাষণ জানানোর জন্য বিকট গলায় চঁচামেচি করতে শুরু করল। অতি উৎসাহী কয়েকজন তরুণ–তরুণী আরো একধাপ এগিয়ে রুখকে টেবিলের উপর টেনে তোলার চেষ্টা করছিল কিন্তু রুথ বেশ কষ্ট করে নিজেকে মুক্ত করে মোটামুটি নিরাপদ দূরত্বে সরে গেল। রুহান হাত তুলে সবাইকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করতে করতে বলল, আমি জানি এটি আমাদের সবার জন্য খুব আনন্দের ব্যাপার—এর আগে আমরা এভাবে আমাদের। প্রিয়জনকে হারিয়েছি। তারা বুদ্ধিমান এনরয়েডদের সাথে দেখা করার জন্য মূল নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রে গিয়ে আর ফিরে আসে নি। আমরা লক্ষ করেছি আমাদের মাঝে যারা বেশি প্রাণবন্ত যারা বেশি বুদ্ধিমান তারা সাধারণত আর ফিরে আসে না–সে কারণে আমরা রুখকে নিয়ে। খুব বেশি দুশ্চিন্তিত ছিলাম। যা–ই হোক–সে সুস্থ দেহে আমাদের মাঝে ফিরে এসেছে, আজ আমাদের খুব আনন্দের দিন। আমি সবার পক্ষ থেকে রুখকে সাদর সম্ভাষণ জানাচ্ছি।
রুখ রুহানের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ একটু অন্যমনস্ক হয়ে যায় তার কেন জানি মনে হতে থাকে রুহানের এই কথাগুলোর মাঝে যেন কী একটা অসঙ্গতি রয়েছে কিন্তু সেটা কী সে ঠিক ধরতে পারে না। রুখ অসঙ্গতিটা কোথায় বোঝার চেষ্টা করছিল। তাই ঠিক লক্ষ করে নি যে সমবেত সবাই চিৎকার করে তাকে ডাকছে, তাকে কিছু একটা বলতে বলছে। ক্রীনা তার পাজরে খেচা দিয়ে ডাকল, রুখ
কী হল?
তুমি কিছু একটা বল।
আমি?
হ্যাঁ–দাঁড়াও।
রুখ তার জায়গায় দাঁড়িয়ে কেশে একটু গলা পরিষ্কার করে বলল, তোমরা সবাই জান যারা বুদ্ধিমান এবং প্রাণবন্ত সাধারণত তারা বুদ্ধিমান এনরয়েডদের কাছে গেলে আর ফিরে আসে না। দেখতেই পাচ্ছ আমি ফিরে এসেছি কাজেই আমি নিশ্চয়ই বোকা এবং অলস।
উপস্থিত সবাই উত্তেজক পানীয়ের কারণে উচ্চৈঃস্বরে হাসতে শুরু করে, রুখ সবার হাসির দমক কমে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করে বলল, কিন্তু যদি আমাকে তোমরা জিজ্ঞেস কর তুমি কি বুদ্ধিমান এবং প্রাণবন্ত হয়ে মারা যেতে চাও নাকি বোকা এবং অলস হয়ে বেঁচে থাকতে চাও–আমি তা হলে বলব বোকা এবং অলস হয়ে বেঁচে থাকতে চাই।
সবাই আবার হাসতে শুরু করে এবং রুখের হঠাৎ মনে হতে থাকে সে এইমাত্র যে কথাটি বলল তার মাঝে কিছু একটা অসঙ্গতি আছে। অসঙ্গতিটি কী সে মনে করার চেষ্টা করে কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারে না। রুখ আবার অন্যমনস্ক হয়ে যায় এবং প্রায় অন্যমনস্কভাবেই নিচু গলায় বলল, আমরা মানুষেরা সম্ভবত খুব গুরুত্বপূর্ণ।
উপস্থিত অনেকে কথাটিকে একটি রসিকতা হিসেবে নিয়ে হেসে ওঠে কিন্তু রুখ তাদের হাসিকে উপেক্ষা করে নেহায়েত অপ্রাসঙ্গিকভাবে গলায় অনাবশ্যক গুরুত্ব আরোপ করে বলল, আমি যতই চিন্তা করি ততই নিশ্চিত হতে থাকি যে মেতসিসে আমাদের অবস্থান খুব গুরুত্বপূর্ণ।
ক্রীনা একটু অবাক হয়ে বলল, কেন? তুমি একথা কেন বলছ?
যেমন মনে কর অক্সিজেনের কথা–পৃথিবীতে অক্সিজেনের মতো ভয়ঙ্কর গ্যাস খুব কম রয়েছে। যে কোনো পদার্থ অক্সিজেনের সংস্পর্শে এলে অক্সিডাইজড হয়ে যায়। যন্ত্রপাতি মরচে ধরে যায়, নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু আমরা–মানুষেরা অক্সিজেন ছাড়া এক মিনিট বাচতে পারি না। তাই শুধুমাত্র আমাদের জন্য মেতসিসের বাতাসে শতকরা কুড়ি ভাগ অক্সিজেন ভরে দেওয়া হয়েছে। চিন্তা করতে পার এই ভয়ঙ্কর পরিবেশে যত এনরয়েড, রোবট, যন্ত্রপাতি আছে তাদের কী দুর্দশা হচ্ছে? তবু তারা সেটা সহ্য করে যাচ্ছে। একদিন নয় দুদিন নয় বছরের পর বছর শতাব্দীর পর শতাব্দী। কেন সহ্য করছে? নিশ্চয়ই এর কোনো কারণ আছে।
উপস্থিত সবাই একটু অবাক হয়ে রুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। মেতসিসে মানুষের মোটামুটি নিরুপদ্রব জীবনে সাধারণত এই ধরনের কথাবার্তা প্রকাশ্যে আলোচনা করা হয় না। এই মহাকাশযানে মানুষ থেকে লক্ষগুণ বেশি বুদ্ধিমান এনরয়েড রয়েছে, তাদের অনুকম্পা ছাড়া মানুষ এখানে এক মিনিটও বেঁচে থাকতে পারত না–এরকম পরিবেশে মানুষের গুরুত্ব বেশি না বুদ্ধিমান এনরয়েডের গুরুত্ব বেশি সেই আলোচনা নেহায়েত অনাবশ্যক!