মানব–সদস্য রুখের সামনে নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে থাকা একটি বুদ্ধিমান এনরয়েড বলল, তুমি তোমার হাতে ধরে রাখা টাইটেনিয়াম রডটি নিচে ফেলে দাও।
কেন?
তুমি সম্ভবত এর আঘাতে আমাদের অন্য কোনো একজনকে বিধ্বস্ত করতে পারবে যদিও সেটি সেরকম গুরুত্বপূর্ণ নয় কারণ আমাদের সকলের সকল স্মৃতি মূল তথ্যকেন্দ্রে সংরক্ষিত থাকে এবং আমরা কিছুক্ষণের মাঝেই নিজেদের পুনর্বিন্যাস করতে পারি।
তার মানে তার মানে–
না। মানুষকে হত্যা করার মতো এটি অপরিবর্তনীয় ঘটনা নয়। কিন্তু তবুও সে ধরনের কাজে আমরা উৎসাহ দিই না। বিশেষ করে তোমার ঠিক পিছনে যে নিরাপত্তা রোবট দাঁড়িয়ে আছে সেটি অত্যন্ত ক্ষিপ্র। তোমার যে কোনো ধরনের নড়াচড়াকে সেটি বিপজ্জনক। মনে করে তোমাকে পুরোপুরি ধ্বংস করে দিতে পারে।
রুখ একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, কিন্তু আমাকে তো মেরেই ফেলবে। মানুষ কখনো মুখ বুজে অবিচার সহ্য করে না। শেষমুহূর্ত পর্যন্ত চেষ্টা করে। আমি এই টাইটেনিয়াম রডটি ফেলব না। কেউ আমার কাছে এলে এক আঘাতে–
বুদ্ধিমান এনরয়েডটি হঠাৎ হাসির মতো শব্দ করে বলল, তোমাদের কিছু কিছু মানবিক অনুভূতি অত্যন্ত ছেলেমানুষি। কাছে না এসেই তোমাদের ধ্বংস করে দেওয়া যায়। তুমি কী চাও?
আমি মানুষের বসতিতে ফিরে যেতে চাই।
ঠিক আছে তুমি ফিরে যাবে।
রুখ থতমত খেয়ে বলল, আমি জীবিত অবস্থায় ফিরে যেতে চাই।
ঠিক আছে তুমি জীবিত অবস্থায় ফিরে যাবে।
রুখ অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে বুদ্ধিমান এনরয়েডটির দিকে তাকিয়ে রইল–সেটি কি সত্যি কথা বলছে?
হ্যাঁ, আমি সত্যি কথা বলছি। তোমাদের কাছে জীবন–মৃত্যু খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের কাছে নয়। তুমি বেঁচে থাকলে বা মারা গেলে আমাদের কিছু আসে–যায় না। সত্যি কথা বলতে কী তুমি যে ঘটনাটি ঘটিয়েছ আমি সেটা একটু বিশ্লেষণ করতে চাই। সে জন্য আমি তোমাকে বাঁচিয়ে রাখতে চাই। এর বেশি কিছু নয়।
কিন্তু—
হ্যাঁ। রুখ কথাটি বলার আগেই এনরয়েড প্রতিবার তার প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিচ্ছে, এই ঘরের তথ্যটুকু তুমি নিতে পারবে না। তোমার স্মৃতি থেকে এই তথ্যটুকু আমরা মুছে দেব।
সেটি কি করা যায়? শুধুমাত্র একটি স্মৃতি একটি বিশেষ স্মৃতি?
হ্যাঁ। করা যায়। তুমি তোমার হাত থেকে টাইটেনিয়াম রডটি ফেলে আমার দিকে এগিয়ে আস।
রুখ বুদ্ধিমান এনরয়েডটির দিকে তাকাল, সেটি কি তার সাথে কোনো ধরনের প্রতারণা করার চেষ্টা করছে?
এনরয়েডটি আবার হেসে ফেলল, বলল, না। আমি তোমার সাথে প্রতারণা করব না। বিশ্বাস কর তোমার সাথে সাধারণ কথাবার্তা চালিয়ে যেতেই আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। আমার কথা যদি বিশ্বাস না কর মানববসতিতে ফিরে গিয়ে একটা পোষা প্রাণীর সাথে ভাব বিনিময়ের চেষ্টা করে দেখ। বুদ্ধিমত্তা একপর্যায়ের না হলে ভাব বিনিময় করা যায় না।
রুখ হাত থেকে টাইটেনিয়াম রডটি ছুঁড়ে ফেলল। এনরয়েডটি বলল, চমৎকার। এবারে তুমি আরেকটু কাছে এগিয়ে এস। তোমার চোখের দিকে তাকাতে হবে–তুমি নিশ্চয়ই জান রেটিনা আসলে মস্তিষ্কের একটা অংশ। মস্তিষ্কের সাথে সরাসরি যোগাযোগ করার জন্য এটি সবচেয়ে সহজ উপায়।
রুখ এনরয়েডটির কাছে এগিয়ে যায়, এনরয়েড তার চোখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, তুমি এই ঘরে কী দেখেছ মানব–সন্তান।
আমি দেখেছি মানববসতির সব মানুষকে তৈরি করে বড় করা হচ্ছে।
কেন?
আমরা যারা আছি তাদের যখন দায়িত্ব শেষ হয়ে যাবে তখন তাদের সবাইকে সরিয়ে দিয়ে
তুমি কথা বলতে থাক।
রুখ কথা বলতে থাকে কিন্তু তার অবচেতন মন হঠাৎ একটি অত্যন্ত বিপজ্জনক খেলায় মেতে ওঠে। এই শীতল ঘরের তথ্যটি সে তার মস্তিষ্কে করে গোপনে নিয়ে যেতে চায়। কীভাবে নেবে সে জানে না, অন্য কোনো তথ্যের সাথে যদি মিশিয়ে দেওয়া যায়? যদি সে কল্পনা করে সে একটি শিশু সে তার মায়ের হাত ধরে ঘুরছে। মায়ের সাথে একটা বিশাল ঘরের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। দরজ ধাক্কা দিতেই সেই দরজা খুলে গেল, তার মা চিৎকার। করে উঠল। রুখ ভয় পেয়ে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে মা?
মা বলল, চোখ বন্ধ করে ফেল, রুখ। চোখ বন্ধ কর—
কেন মা? কী হয়েছে?
ভয় পাবি। তুই দেখলে ভয় পাবি।
কী দেখলে ভয় পাব?
মানুষ। শত শত মানুষকে ঝুলিয়ে রেখেছে।
কোন মানুষ এরা?
মানববসতির মানুষ।
মা, এরা কি মৃত?
না বাবা। এরা সব ঘুমিয়ে আছে।
কেন ঘুমিয়ে আছে?
জানি না। কিন্তু একদিন জেগে উঠবে–কিন্তু সেটি হবে খুব ভয়ঙ্কর
কেন ভয়ঙ্কর মা? কেন?
আমি জানি না জানি না
মা হঠাৎ আর্তচিৎকার করতে থাকে, রুখের চোখের সামনে সবকিছু অন্ধকার হয়ে আসে। জ্ঞান হারিয়ে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ার আগের মুহূর্তে নিরাপত্তা রোবটটি তাকে ধরে ফেলল।
বুদ্ধিমান এনরয়েডটি খানিকক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে রুখের অচেতন দেহের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, মানুষের বুদ্ধিমত্তা সম্ভবত যথার্থ নিরূপণ করা হয় নি।
কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকা অন্য একটি এনরয়েড বলল, তুমি কেন এই কথা বলছ?
জানি না। আমার স্পষ্ট মনে হল এই মানুষটি—
এই মানুষটি?
এই মানুষটি আমাকে লুকিয়ে কিছু একটা জিনিস করল।
তোমাকে লুকিয়ে?
হ্যাঁ। যখন তার স্মৃতি মুছে ফেলছি তার নিউরনকে মুক্ত করছি তখন মনে হল অন্য কোথাও সে নিউরনকে উজ্জীবিত করছে–