হ্যাঁ। পঞ্চাশবার সৃষ্টি করে পঞ্চাশবার ধ্বংস করা হয়েছে।
যখন এদের নতুন করে সৃষ্টি করা হয় তখন এদের স্মৃতিতে কী থাকে?
তুমি জান কী থাকে। তোমাকেও একদিন সৃষ্টি করা হয়েছিল।
রুখ হঠাৎ বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো চমকে উঠল–তার শৈশব তার কৈশোর তার যৌবনের সকল স্মৃতি আসলে মিথ্যা? আসলে এইভাবে তার শীতল দেহকে ধীরে ধীরে বড় করা হয়েছে? এইভাবে তার মস্তিষ্কে মিথ্যা কাল্পনিক একটা স্মৃতি প্রবেশ করানো হয়েছে? মায়ের কোলে বসে বসে সে বাইরে তাকিয়ে আছে, মা মিষ্টি সুরে গান গাইছে–সব মিথ্যা?
রুখ একটি নিশ্বাস ফেলল, হঠাৎ করে তার কাছে তার পুরো জীবন, এই মহাকাশযান, তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা কদাকার এনরয়েড, বিশাল হলঘরে সারি সারি ঝুলে থাকা মানুষের দেহ সবকিছুকে কেমন জানি অর্থহীন বলে মনে হতে থাকে।
মানব–সদস্য এনরয়েডটি রুখের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি খুব বেশি জেনে গিয়েছ।
আমি জানতে চাই নি।
কিন্তু তুমি জেনেছ। এই তথ্য নিয়ে তুমি মানববসতিতে ফিরে যেতে পারবে না।
রুখ অন্যমনস্কভাবে এনরয়েডটির দিকে তাকাল, তাকে এখন মেরে ফেলা হবে ব্যাপারটিও কেন জানি আর সেরকম গুরুত্বপূর্ণ মনে হচ্ছে না।
মানব–সদস্য–আমি যতদূর জানি মৃত্যুকে তোমরা খুব ভয় পাও।
পাই।
তোমার স্মৃতিতে ক্রীনা নামের একটি মেয়ের রূপ অনেকবার এসেছে।
রুখ কোনো কথা না বলে কদাকার এনরয়েডটির দিকে তাকাল। এনরয়েডটি হাসির মতো শব্দ করে বলল, তোমার মৃত্যুর খবরে সে নিশ্চয়ই খুব বিচলিত হবে।
রুখ এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে এনরয়েডটির দিকে তাকিয়ে রইল, মানুষ থেকে বুদ্ধিমত্তায় অনেক উন্নত হলেই কি তাদেরকে মানুষ থেকে অনেক বেশি নিষ্ঠুর হতে হবে?
তোমার মৃত্যুর খবরে তার মস্তিষ্কে কী ধরনের চাঞ্চল্য হয় দেখার একটু কৌতূহল হচ্ছে। সত্যি কথা বলতে কী যদি সুযোগ থাকত আমি ক্রীনাকে এনে তার সামনে তোমাকে হত্যা করতাম
হঠাৎ করে রুখের মনে হল তার মস্তিষ্কে একটি বিস্ফোরণ ঘটেছে। সে হিংস্র চোখে এনরয়েডটির দিকে তাকাল, দাঁতে দাঁত ঘষে বলল, মহামান্য এনরয়েড, আপনি সম্ভবত বুদ্ধিমত্তায় আমার থেকে দুই মাত্রা উপরে কিন্তু আপনার কৌতূহলটুকু আমার কাছে দুই মাত্রা নিচের এক ধরনের অসুস্থতা বলে মনে হচ্ছে।
এনরয়েডটি রুখের দিকে ঘুরে তাকাল, কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে এক ধরনের শীতল কণ্ঠে বলল, মানব–সদস্য, তুমি নিশ্চয়ই তোমার অবস্থানটুকু জান। আমি তোমার চোখের রেটিনার দিকে তাকিয়ে তোমার মস্তিষ্কের সকল নিউরনকে ছিন্নভিন্ন করে দিতে পারি!
রুখ হঠাৎ চিৎকার করে বলল, আমি কি সেটাকে ভয় পাই?
পাও না?
না। বুদ্ধিমত্তার কোন স্তরে কে থাকে তাতে কিছু আসে–যায় না, যার বুকের ভিতরে কোনো ভালবাসা নেই তার সাথে দানবের কোনো পার্থক্য নেই। মানুষ দানবকে ঘেন্না করে, ভয় পায় না।
আহাম্মক! এনরয়েডটি চিৎকার করে বলল, তোমার মতো শত শত মানুষকে আমরা কীটপতঙ্গের মতো পিষে ফেলি
হঠাৎ করে রুখ নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলল। মাথা ঘুরিয়ে দেয়ালের সাথে লাগানো একটি টাইটেনিয়াম রড হ্যাঁচকা টানে খুলে নেয়। তারপর দুই হাতে ধরে সে এনরয়েডটির দিকে এগিয়ে গেল। দাতে দাঁত ঘষে হিংস্র গলায় বলল, মানুষকে হত্যা করতে চাইলে করতে পার–কিন্তু তাকে তার প্রয়োজনীয় সম্মানটুকু দিতে হবে।
এনরয়েডটি এক পা পিছিয়ে বলল, খবরদার! তার শরীর থেকে হঠাৎ তীব্র অবলাল রশি এসে রুখকে আঘাত করল–রুখ প্রচণ্ড যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠে অন্ধ আক্রোশে হাতের রডটি দিয়ে এনরয়েডটির মাথায় আঘাত করল। এনরয়েডটি সরে যাওয়ায় আঘাতটি লাগল মাথা থেকে বের হয়ে আসা একটি টিউবে। হঠাৎ করে টিউবটি মাথা থেকে খুলে আসে এবং তার ভেতর থেকে গলগল করে আঠালো সবুজ রঙের এক ধরনের তরল বের হতে থাকে। ঝাজালো গন্ধে হঠাৎ ঘরটা ভরে গেল।
এনরয়েডটি আর্তচিৎকার করে বলল, আমার তরল! আমার কপোট্রন শীতলকারী তরল!
রুখ হতচকিত হয়ে এনরয়েডটির দিকে তাকিয়ে থাকে। সে রাগে অন্ধ হয়ে এনরয়েডটিকে আঘাত করেছে সত্যি কিন্তু তার আঘাত যে সত্যি সত্যি মানুষের থেকে দুই মাত্রা বেশি বুদ্ধিমান একটি যন্ত্রের কোনো ক্ষতি করতে পারবে সেটি সে একবারও বিশ্বাস করে নি। এনরয়েডটি একবার দুলে উঠে পড়ে যেতে যেতে সেটি কোনোভাবে নিজেকে সামলে নেয়। এনরয়েডটির মাথার একটি অংশ উত্তপ্ত হয়ে ওঠে, সেখান থেকে ধোঁয়া বের হতে শুরু করে। উত্তপ্ত অংশটি হঠাৎ গনগনে লাল হয়ে ওঠে এবং এনরয়েডটি দুই হাতে নিজের মাথা চেপে ধরে আর্তচিৎকার করে ওঠে, আমার স্মৃতি আমার স্মৃতি–আহা—হা-হা–আমার স্মৃতি
রুখ হতচকিত হয়ে তাকিয়ে রইল এবং হঠাৎ করে এনরয়েডটির পুরো মাথাটি প্রচণ্ড বিস্ফোরণে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল। মাথার অংশটি থেকে কিছু পোড়া টিউব, তার এবং ফাইবার বের হয়ে ঝুলে থাকে, ফিনকি দিয়ে থিকথিকে এক ধরনের তরল বের হতে থাকে এবং এনরয়েডটির দুটি অপুষ্ট হাত কিলবিল করে নড়তে থাকে। সমস্ত ঘরটি এক ধরনের বিষাক্ত গন্ধে ভরে যায় এবং দূরে কোথাও তারস্বরে এলার্ম বাজতে শুরু করে। পুরো দৃশ্যটিকে রুখের কাছে একটি অতিপ্রাকৃতিক দুঃস্বপ্নের মতো মনে হয়।
কয়েক মুহূর্তের মাঝে ঘরটির মাঝে অসংখ্য রোবট এবং এনরয়েড এসে হাজির হল। যান্ত্রিক রোবটগুলো বিধ্বস্ত এনরয়েডকে সরিয়ে নিয়ে যায়, বিশেষ নিরাপত্তা রোবট ঘরটিকে পরিশোধন করতে থাকে। নিরাপত্তা রোবট রুখের খুব কাছাকাছি এসে দাঁড়ায়, দেখে বোঝা গেলেও এই রোবটগুলো নিশ্চয় সশস্ত্র, হাতে ধরে রাখা টাইটেনিয়াম রডটি একটু নাড়ালেই সম্ভবত তাকে বাষ্পীভূত করে ফেলবে।