জাহিদ কামালের দিকে তাকাল—কামাল বিরস মুখে হেসে বলল,—কি জন্যে এত সাবধানতা?
হাকশী একটু গম্ভীর হয়ে বলল, আমি যে পরিকল্পনামাফিক কাজ করছি, সেখানে সাবধান না হলে চলে না।
কি তোমার পরিকল্পনা?
সময় হলেই জানবে। আমার পরিকল্পনামাফিক কাজ করতে হলে শ দুয়েক প্রথম শ্রেণীর বিজ্ঞানী, শ’ তিনেক প্রথম শ্রেণীর ইঞ্জিনিয়ার আর টেকনিশিয়ান দরকার। কিন্তু সবাই যে আমার পরিকল্পনাকে ভালো চোখে দেখবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। কাজেই অনেককে আমার জোর করে ধরে আনতে হয়েছে।
জেসমিন চমকে উঠে বলল, বছরখানেক আগে হঠাৎ করে যেসব বিজ্ঞানী অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল তাদের তুমি ধরে এনেছ?
হাকশী হাসিমুখে বলল, হ্যাঁ। যাদের আমি এখানে নিয়ে এসেছি তাদের সাথে আমার চুক্তি হচ্ছে দু বছরের। ঠিক দু বছর তারা এখানে কাজ করবে, তারপর আমি তাদের পৃথিবীতে ফেরত পাঠাব।
জেসমিন জিজ্ঞেস করল, আমাদেরও কি দু’ বছর থাকতে হবে?
হাকশী খানিকক্ষণ কি ভেবে বলল, আসলে তোমাদের ধরে আনার কোনো পরিকল্পনা ছিল না। কিন্তু লেসার দিয়ে আমার ফোববাসে ফুটো করার সময় আমার অনেকগুলি লোক মারা পড়েছে বিশ্বস্ত সব লোক! বুঝতেই পারছ, আমি যখন অপারেশনে যাই সবচেয়ে বিশ্বস্ত লোকগুলি নিয়ে যাই। কাজেই আমার কয়েকজন লোক কম পড়ে গেছে—বাধ্য হয়ে হাতের কাছে যাদের পেয়েছি ধরে এনেছি।
জেসমিন আবার জিজ্ঞেস করল, আমাদের কি দু বছর পর ছেড়ে দেবে?
হাকশী বাকা করে হেসে বলল, তোমাদের সাথে আমার কোনো চুক্তি নেই—দু বছর পর ছেড়ে দেব একথা জোর দিয়ে বলা যাচ্ছে না।
জেসমিন কাতর হয়ে বলল, হাকশী। আমাদের সাথে অন্য রকম ব্যবহার করে তোমার লাভ?
হাকশী হেসে বলল, কেন তোমরা আমাকে ধ্বংস করে যাবে?
জেসমিন চুপ করে রইল। ফ্রিপসির মতো একটি কম্পিউটার যেখানে সবার উপর তীক্ষ্ণ নজর রাখছে, পৃথিবীর সেরা সেরা সব প্রতিভাবান ব্যক্তিরা যেখানে অসহায়ভাবে বন্দি হয়ে রয়েছে সেখানে তারা কতটুকু কি করতে পারবে?
হাকশী ধূর্ত চোখে হাসতে হাসতে বলল, এখন বুঝতে পারছ, আমি কেন এত সাবধান হয়ে থাকি?
শ’ চারেক প্রতিভাবান বিজ্ঞানী, ইঞ্জিনিয়ার, টেকনিশিয়ান আমার হয়ে কাজ করছে—যদিও তাদের একজনও আমাকে দু চোখে দেখতে পারে না। পৃথিবীর অন্য যেকোনো ব্যক্তি হলে অনেক আগেই এদের হাতে মারা পড়ত—আমি বলে টিকে আছি। শুধু টিকে আছি বললে ভুল হবে—এদের কাছ থেকে আমার কাজও আদায় করে নিচ্ছি। কিন্তু কেউ আমার বিরুদ্ধে টু শব্দ করে নি।
জাহিদ দাঁতে দাঁত ঘষে বলল, যেদিন সুযোগ আসবে—
আসবে না। যদি কখনো আসে, সে-সুযোগ গ্রহণ করার অনুমতি আমি আগেই দিয়েছি। তবে হ্যাঁ—
কি?
খুব ধীরে ধীরে হাকশীর মুখ শক্ত হয়ে গেল। চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, দু’বারের বেশি কেউ সুযোগ পাবে না। প্রথম দু’বার আমি ক্ষমা করে দিই—কিন্তু যেই মুহুর্তে কেউ তৃতীয়বার আমাকে ধ্বংস করার পরিকল্পনা করে—আমি নিজ হাতে তাকে শাস্তি দিই।
কি রকম শাস্তি?
শুনবে? তা হলে শোন। একজন জার্মান ছোকরাকে খালিগায়ে মহাকাশে ছেড়ে দিয়েছিলাম। এক সেকেন্ডের দশ ভাগের এক ভাগ সময়ে সে বেলুনের মতো ফেটে গিয়েছিল!
জেসমিন শিউরে উঠে বলল, কী করেছিল ছেলেটা?
কামালের মতো আমাকে মারতে চেষ্টা করেছিল। প্রথমবার ইলেকট্রিকে শর্ট সার্কিট করে, দ্বিতীয়বার দম বন্ধ করে, তৃতীয়বার হাতুড়ির আঘাত দিয়ে। কোনোবারই কিছু করতে পারে নি। পরিকল্পনা করার সাথে সাথেই ফ্রিপসি আমাকে জানিয়ে দিয়েছিল—
মানে? শুধু পরিকল্পনা করেছিল, আর অমনি তুমি ওকে মেরে ফেললে?
হাকশী জাহিদের দিকে তাকিয়ে হাসল। বলল, তুমি কি ভাবছ এখানে কোনো পরিকল্পনা করে সেটা কাজে লাগানোর মতো সুযোগ কাউকে দেয়া হয়?
কামাল অধৈর্য হয়ে বলল, তা হলে যে-কেউ একবার একবার করে তিনবার পরিকল্পনা করলেই তুমি তাকে শাস্তি দেবে? কিছু না করলেও?
না—পরিকল্পনা করার স্বাধীনতা রয়েছে কিন্তু তুমি যদি সেটা বাস্তবায়ন করার জন্যে সময় ঠিক কর, তাহলেই আমি একবার ওয়ার্নিং দেব। দ্বিতীয়বার আবার যদি কবে কোথায় কি করবে ঠিক কর, তা হলে শেষ ওয়ার্নিং। তৃতীয়বার–
হাকশী কথা বন্ধ করে গলার উপর ছুরি চালানোর ভান করল।
জাহিদ হাকশীর প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট নিয়ে ধীরে ধীরে ধরাল, তারপর আপন মনে বলল, তার মানে তোমায় কীভাবে কোথায় শেষ করব ভাবতে কোনো বাধা নেই, কিন্তু যেই মুহূর্তে সময় ঠিক করব অমনি তুমি একবার সুযোগ দেয়া হয়েছে বলে ধরে নেবে!
হ্যাঁ।
যদি তুমি বা তোমার ফ্রিপসি কিছু জানতে না পার, আর তার আগেই তোমায়। শেষ করি?
হাকশী হো-হো করে হেসে বলল, চেষ্টা করে দেখতে পার। তোমার পুরো স্বাধীনতা রয়েছে।
ঘড়িতে একটা শব্দ হল। অমনি হাকশী উঠে দাঁড়াল, বলল, আমার সময় হয়েছে–তোমাদের কার কি কাজ করতে হবে, সব এই ফাইলটায় লেখা রয়েছে। আজ বিকেল থেকেই কাজ শুরু করে দাও।
হাকশী একটা ফাইল ওদের দিকে এগিয়ে দেয়। জাহিদ বিরস মুখে ফাইলের পৃষ্ঠা ওল্টাতে থাকে—খুটিনাটি বিষয় সবকিছু লেখা রয়েছে—কখন কবে কি কাজ করতে হবে তার নিখুঁত বিবরণ।
হাকশী চলে যাচ্ছিল—জেসমিন ডেকে ফেরাল, হাকশী—আমাদের কতদিন থাকতে হবে বললে না?
হাকশী হেসে বলল, কেন? আমায় ধ্বংস করে নিজেরা মুক্ত হয়ে যাবে না?
জাহিদ হেসে বলল, এক শ বার যাব। তাহলে আমায় জিজ্ঞেস করছ কেন?