- বইয়ের নামঃ ব্ল্যাকহোলের বাচ্চা
- লেখকের নামঃ মুহম্মদ জাফর ইকবাল
- প্রকাশনাঃ সময় প্রকাশন
- বিভাগসমূহঃ বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী
০১. আমরা যে ছোট শহরটাতে থাকি
আমরা যে ছোট শহরটাতে থাকি সেখানে একটা খুব হাইফাই স্কুল আছে-স্কুলটার নাম অক্সব্রীজ ইন্টারন্যাশনাল স্কুল। অক্স মানে হচ্ছে ষাঁড় আর ব্রীজ মানে হচ্ছে পুল, তার মানে অক্সব্রীজ হচ্ছে ষাঁড়ের পুল। ষাঁড় দিয়ে কেমন করে পুল তৈরী করে আর একটা স্কুলের নামে কেন ষাড় শব্দটা থাকতে হবে সেটা আমরা কোনোদিন বুঝতে পারি নাই। তখন একদিন বগা খবর আনল যে আসলে অক্সব্রীজ শব্দটা তৈরী হয়েছে অক্সফোর্ড আর ক্যামব্রীজ একত্র করে। অক্সফোর্ড আর ক্যামব্রীজ নাকী লন্ডন না আমেরিকা না জাপানের খুব বড় বড় স্কুল, আর আমাদের শহরের অক্সব্রীজ ইন্টারন্যাশনাল স্কুলও একদিন অক্সফোর্ড আর ক্যামব্রীজ থেকেও বিখ্যাত হয়ে যাবে তাই আগে থেকেই এইভাবে নাম রাখা হয়েছে। এই স্কুলের ছেলেমেয়েদের দেখলে অবশ্যি মনে হয় তাদের স্কুল বুঝি এখনই অক্সফোর্ড আর ক্যাব্রীজ থেকেও বিখ্যাত হয়ে গেছে। এই স্কুলের ছেলেমেয়েদের অবশ্যি রাস্তাঘাটে খুব বেশী দেখা যায় না, তার কারণ এই স্কুলে শুধু বড়লোকের ছেলেমেয়েরা পড়ে আর বড়লোকের ছেলেমেয়েরা সবসময় গাড়ী করে স্কুলে যায় আসে। যদি কখনো কোনো কারণে তাদের রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হয় তখন তাদের দেখলে মনে হয় তাদের চারপাশে বুঝি ময়লা আবর্জনা রোগ জীবানু ভাইরাস আর তারা খুব সাবধানে নাক মুখ কুচকে রোগ জীবানু ভাইরাস ময়লা আবর্জনা বাঁচিয়ে কোনোমতে হেঁটে যাচ্ছে।
অক্সব্রীজ স্কুলের ছেলেমেয়েরা যেহেতু সবাই বড়লোকের ছেলেমেয়ে তাই তাদের চেহারায় তার স্পষ্ট ছাপ আছে। তারা সবাই গোলগাল নাদুসনুদুস, তাদের গায়ের রং সাদা তেলাপোকার মত ফর্সা, তাদের ঠোঁটগুলো চিকন আর চোখগুলো সরু। সেই সরু চোখে মাত্র দুইটি জিনিষ, আমাদের জন্যে তাচ্ছিল্য আর তাদের নিজেদের জন্যে অহংকার। অক্সব্রীজ স্কুলের ছেলেমেয়েদের সাথে আমাদের কখনো সরাসরি কথা হয় নাই কিন্তু আমি তাদের নিজেদের মাঝে কথা বলতে শুনেছি। মনে হয় তারা বাংলায় কথা বলতে পারে না তাই সব সময় ইংরেজীতে কথা বলে। মাঝে মাঝে যখন বাংলায় কথা বলে তখন মনে হয় তাদের কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে। ঠোঁটগুলো চেপে রেখে কেমন জানি নাক দিয়ে কথা বলে। বাংলাদেশকে তারা বলে ব্যাংলাদেশ, করতে পারি কে বলে কোড়তে পাড়ি, টমেটোকে বলে টোমাটো। তাদের হাইফাই স্কুলের মতো পোষাকটাও অনেক হাইফাই। ধবধবে সাদা শার্ট, কুচকুচে কালো প্যান্ট, সাদা মোজা, কালো জুতো, সু আর টকটকে লাল টাই। শুধু যে ছেলেরা টাই পরে তা নয় মেয়েরাও টাই পরে। এক কথায় বলা যায় অক্সব্রীজ স্কুলের ছেলেমেয়েদের চুলের ডগা থেকে পায়ের তলা পর্যন্ত পুরোটুকুর মাঝে একটা চকচকে ঝকঝকে ভাব।
বোঝাই যাচ্ছে এই ছেলেমেয়েগুলোকে দেখে আমাদের অনেক হিংসা হয়, কিন্তু আমরা সেটা কখনো প্রকাশ করি না। আমরা তাদের চোখের কোনা দিয়ে দেখলেও সব সময় ভাণ করি তাদেরকে দেখি নাই। যদি কখনো দেখতেই হয় তাহলে মুখের মাঝে একটা তাচ্ছিল্যের ভঙ্গী ফুটিয়ে তাদের দিকে তাকাই। এ ছাড়া আমাদের অবশ্যি কোনো উপায়ও নেই কারণ আমাদের স্কুলটা অক্সব্রীজ স্কুলের ঠিক উল্টো। অক্সব্রীজ স্কুলের সবকিছু যেরকম হাইফাই আমাদের স্কুলের সবকিছু সেরকম ল্যাটাপ্যাটা। যেমন আমাদের স্কুলের নাম হচ্ছে হাজী মহব্বতজান উচ্চ বিদ্যালয়। স্কুলের যে অবস্থা, এর নাম হওয়া উচিৎ ছিল পাজী মহব্বতজান নিম্ন বিদ্যালয়। মহব্বতজান হচ্ছে এই এলাকার এক বিশাল সন্ত্রাসী, থানায় তার নামে কম করে হলেও এক ডজন খুনের মামলা আছে। তার মিশমিশে কালো রং, টকটকে লাল চোখ, আর পান খাওয়া ক্যাটক্যাটে হলুদ দাঁত। মাথা ফুটবলের মতন একটা চুলও নাই। মাথায় চুল গজায় না নাকী সে কামিয়ে ফেলে সেটা কেউ জানে না। সন্ত্রাসী মহব্বতজান হঠাৎ একদিন হজ করে চলে এল, তখন তার চেহারার একটু পরিবর্তন হল, থুতনীতে কয়েকটা দাড়ি আর মাথায় একটা টুপি, নাম হয়ে গেল হাজী মহব্বতজান। কী তার মতলব কে জানে, মানুষের জমি দখল করে সেখানে একটা স্কুল, দুইটা মাদ্রাসা আর একটা কলেজ বানিয়ে ফেলল। তার বানানো সেই স্কুলটাই হচ্ছে আমাদের এই স্কুল। এই শহরে তার নামে স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ছাড়াও আছে মহব্বতজান মার্কেট, মহব্বতজান কোল্ড স্টোরেজ আর মহব্বতজান ইটের ভাটা। এই শহরের সবচেয়ে যেটা ভয়ংকর সেটা হচ্ছে তার নামে একটা দৈনিক পত্রিকা, সেটার নাম হচ্ছে দৈনিক মহব্বত। সেই পত্রিকায় হাজী মহব্বতজানের নানা কম ভালো ভালো খবর ছাপা, যে খবরে তার নামের আগে লেখা হয় দানবীর হাজী মহব্বতজান।
আমাদের স্কুলের কোনো পোষাক নাই যার যা ইচ্ছা পরে চলে আসে। বগা দাবী করে একটা নাকী পোষাক আছে লাল পায়জামা বেগুনী সার্ট কিন্তু সেটা কেউ প্রমান করতে পারে নাই। আমাদের স্কুলে কোনো লেখাপড়া হয় না। আমরা স্কুলে আসি কথাবার্তা বলি। গল্পগুজব করি, ঝগড়াঝাটি মারামারি করি তারপর ধীরে সুস্থে বাসায় যাই। কোনো কোনো ক্লাশে স্যার ম্যাডাম আসেন। তাদের মাঝে বেশীরভাগই হয় মোবাইলে কারো সাথে কথা বলেন, তা না হলে চেয়ারে পা তুলে বসে বসে ঘুমান। অন্যরা পড়ানোর নামে আমাদের বেত দিয়ে পিটান। আমাদের স্কুলে যে কোনো ছেলে মেয়ে যে কোনো ক্লাশে ভর্তি হতে পারে, তাই যারা অন্য কোনো স্কুলে ভর্তি হতে পারে না তারা আমাদের স্কুলে এসে ভর্তি হয়। অন্য স্কুল থেকে যাদেরকে টিসি দিয়ে বিদায় করে দেয়া হয় তারা সবাই আমাদের স্কুলে এসে ভর্তি হয়। কেউ অবশ্যি বেশীদিন থাকে না, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাদের বাবা মায়েরা তাদেরকে অন্য একটা স্কুলে নিয়ে যায়। আমরা যে কয়জন অনেকদিন থেকে এই স্কুলে আছি তাদের বাবা মায়েদের আসলে আমাদের জন্যে কোনো মাথা ব্যথা নেই।