জাহিদ, কামাল আর জেসমিনকে মোটেই পাহারা দিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল না, যে-লোকটি পথ দেখিয়ে আনছে সে সামনে সামনে হাঁটছে, পিছন পিছন কেউ আসছে কি না সে বিষয়েও কোনো কৌতূহল নেই। কামাল টেকনিশিয়ানের কাছে এসে এদিক সেদিক তাকাল, তারপর আলগোছে একটা বড়সড় ভ্রু-ড্রাইভার তুলে নিল—সে এক বছর জুডো ট্রেনিং নিয়েছিল, খালিহাতেই কীভাবে মানুষ মারতে হয় জানে, তবে এ ধরনের ভ্রু-ড্রাইভার সাথে থাকলে ব্যাপার সহজ হয়। হারুন হাকশীর কাছাকাছি যেতে পারলে একবার চেষ্টা করে দেখবে, এই লোকটি শেষ হয়ে গেলে পুরো পূটোনিকই শেষ হয়ে যাবে।
হারুন হাকশীর ঘরটা আগোছাল, যন্ত্রপাতিতে ঠাসা। বিভিন্ন মিটার আর স্ক্রীনগুলি সে চিনতে পারল, যে-কোনো মহাকাশযানেই থাকে। তবে অচেনা যন্ত্রপাতির মাঝে রয়েছে একটা চৌকোণা একমানুষ উচু ইউনিট, যেটিকে দেখে কম্পিউটার মনে হচ্ছিল, যদিও পরিচিত কম্পিউটারের সাথে এর কোনো মিল নেই। ওরা ঢুকতেই হারুন হাকশী ওদের দিকে না তাকিয়ে বলল, বস। কামাল বসল একপাশে, হারুন হাকশীর নাগালের ভিতর।
হারুন হাকশী একটা ফিতের মতো কাগজে কী যেন মন দিয়ে পড়ছিল—পড়া শেষ হলে কাগজটি রেখে দিয়ে ওদের দিকে তাকাল। তারপর কামালের দিকে তাকিয়ে হেসে বলল, স্ক্রু-ড্রাইভারটি দিয়ে দাও।
কামাল চমকে উঠে হতভম্বের মত পকেট থেকে ক্রু-ড্রাইভারটি বের করে। ঝাঁপিয়ে পড়ে শেষ করে দেবে কি না ভাবছিল, কিন্তু তার আগেই লক্ষ করল হারুন হাকশীর হাতে ছোট একটা রিভলবার। স্কু-ড্রাইভারটি এগিয়ে দিয়ে কামাল হতাশ হয়ে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসল।
হারুন হাকশী রিভলবারটি ড্রয়ারে রেখে একটা সিগারেট ধরিয়ে নেয়। খানিকক্ষণ একমনে সিগারেট টেনে বলল, তোমাদের ফ্রিপসির সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়নি—এই হচ্ছে ফ্রিপসি হারুন হাকশী চৌকোণা ইউনিটের দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়।
কি জিনিস এটা?
কম্পিউটার।
ও। কোন জেনারেশন?
হারুন হাকশী হাত ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, এটা তোমাদের ওসব চতুর্থ শ্রেণীর কম্পিউটার না—যে, জেনারেশন হিসেব করবে। এটি হচ্ছে আমার নিজের হাতে তৈরি কম্পিউটার।
জাহিদ নির্দোষ মুখে বলল, কি করে এটা? গান গায়?
হাকশী চটে উঠে বলল, কি করে, শুনবে? সে ফিতের মতো কাগজটি তুলে নেয়, বলে, শোন আমি পড়ছি, কামাল সম্পর্কে কী লিখেছে শোন। কামাল হচ্ছে অস্থিরমতি—আপাতত হারুন হাকশীকে কীভাবে হত্যা করা যায় তাই ভাবছে। করিডোরে আসার সময় খুঁটিনাটি লক্ষ করতে করতে আসবে। সুইচ-বক্সের সামনে এসে হঠাৎ করে এদিক-সেদিক তাকিয়ে একটা ক্রু-ড্রাইভার তুলে নেবে। প্রথম সুযোগ পাওয়ামাত্র এটা দিয়ে হাকশীকে হত্যার চেষ্টা করবে। হারুন হাকশী বসতে বলার পর সে পাশে বসবে। বসার তিন মিনিট পর সে লাফিয়ে উঠে ঝাঁপিয়ে পড়বে হারুন হাকশীর উপর–
শুনতে শুনতে কামালের চোয়াল ঝুলে পড়ল। জাহিদের বিস্ফারিত চোখের দিকে তাকিয়ে হাকশী বলল, ফ্রিপসি তোমার সম্পর্কে কী বলেছে শুনবে? এই শোন—সে পড়তে থাকে, সকাল আটটা পয়ত্রিশঃ জাহিদ ঘরে গোপন মাইক্রোফোন রয়েছে কি না পরীক্ষা করে দেখার জন্যে হঠাৎ করে কামালকে বলবে—তার শার্টের বোতামে যেএক্সপ্লোসিভটা ছিল সেটা আছে কি না। তারপর সে কামালকে এটা চালু করতে বলবে। কেউ এক্সপ্লোসিভটা নিতে আসবে না দেখে জাহিদ ভাববে, ঘরে কোনো মাইক্রোফোন নেই… এখন বুঝতে পারলে ফ্রিপসি কী করে?
তার মানে এটা মানুষের মনের কথা বলে দেয়?
ঠিক মনের কথা বলা নয়—এটা ভবিষ্যৎ বলে দেয়। ভবিষ্যৎ?
হ্যাঁ, যে-কোনো মানুষ ভবিষ্যতে কখন কী করবে, কখন কী বলবে, সব নিখুঁতভাবে বলে দেয়।
অসম্ভব।
হাকশী হাসিমুখে বলল, বিজ্ঞানী হয়েও এরকম অবৈজ্ঞানিক কথা বলছ! এইমাত্র নিজের চোখে দেখলে নিজের কানে শুনলে!
কিন্তু এটা কী করে সম্ভব? কামাল হাত ঝাঁকিয়ে বলল—ভবিষ্যতে কে কী করবে না-করবে সেটা বলা যায় নাকি?
কেন যাবে না। যেমন মনে কর তোমার কথা। আমি যদি তোমার মানসিকতা, তোমার বুদ্ধিমত্তা, তোমার পার্সোনালিটি, তোমার পছন্দ-অপছন্দ সব কিছু নির্ভুল জানতে পারি, তা হলে কখন কী পরিবেশে তুমি কী রকম ব্যবহার করবে আমি মোটামুটি বলতে পারব না?
কামাল খানিকক্ষণ চিন্তা করে বলল, মোটামুটি হয়তো বলতে পারবে।
আর যদি একটি অসাধারণ কম্পিউটারকে একজন মানুষের চরিত্রের যাবতীয় খবর দেয়া হয়, সে কি নিখুঁতভাবে বলতে পারবে না, কী পরিবেশে তার কী রকম ব্যবহার করা উচিত?
কিন্তু আমার চরিত্রের বৈশিষ্ট্য সে কেমন করে জানবে?
তোমার কণ্ঠস্বরের একটিমাত্র শব্দ যদি ফ্রিপসি শুনতে পায়, সে নিখুত বলে দেবে তোমার চরিত্র কেমন!
সে কেমন করে সম্ভব?
তোমার চরিত্রের উপর নির্ভর করবে তোমার কণ্ঠস্বর, শব্দের বিভিন্ন অংশে তোমার দেয়া গুরুত্ব, উচ্চারণভঙ্গি। তোমার আমার কানে সেগুলি ধরা পড়বে না কিন্তু পিসি সেটা মুহুর্তে ধরে ফেলতে পারে। যেখানে ফ্রিপসির একটিমাত্র শব্দ শুনলেই চলে, সেখানে আমি প্লুটোনিকে এমন ব্যবস্থা করেছি যেন সে প্রতিমুহূর্তে প্লুটোনিকের প্রত্যেকটি মানুষের প্রত্যেকটা কথা শুনতে পায়, প্রত্যেকটা ভাবভঙ্গি দেখতে পায়।
মানে?
মানে এই প্লুটোনিকের প্রতি সেন্টিমিটার ফ্রিপসি প্রতিমুহূর্তে দেখতে পায়–প্রত্যেকটা নিশ্বাসের শব্দ সে শুনতে পায়! টেলিভিশন, ক্যামেরা আর মাইক্রোফোন দিয়ে পুরো প্লুটোনিক ঘিরে রাখা হয়েছে।