গাঢ় নীল রংয়ের জ্যাকেট আর সাদা পান্ট পরনে। মাথায় লম্বা চুল অবিন্যস্ত, মুখে খোঁচা লালচে দাড়ি। গায়ের রং অস্বাভাবিক ফর্সা, তীক্ষ্ণ খাড়া নাক, শক্ত চোয়াল এবং রক্তাক্ত চোখ দুটি জ্বলজ্বল করে জ্বলছে।
জাহিদের মনে হল লোকটিকে কোথায় যেন দেখেছে, কিন্তু মনে করতে পারছিল না। কামাল বিস্ফারিত চোখে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে হঠাৎ চিৎকার করে বলল, তুমি হারুন হাকশী।
সাথে সাথে জাহিদ লোকটিকে চিনতে পারল। অসাধারণ প্রতিভাবান হারুন হাকশী মাত্র চব্বিশ বছর বয়সে নোবেল পুরষ্কারের জন্যে মনোনীত হয়েছিল—বয়স কম বলে সেবার দেয়া হয়নি। এক অজ্ঞাত কারণে এত প্রতিভাবান হওয়ার পরও তার রক্তে অপরাধের বীজ ঢুকে গেছে দু’টি খুন করে দেশ ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিল—নাম পাল্টে কিছুদিন এক মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্রে কাজ করেছে। ধরা পড়ে মাস ছয়েক জেল খেটে জেল থেকে পালিয়ে যাবার পর তার আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায় নি।
জাহিদ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে স্যারদের কাছে হাকশীর গল্প শুনত। প্রতিভাবান ব্যক্তিরা নাকি একটু পাগলাটে হয়, কিন্তু তারা যে ক্রিমিনালও হতে পারে হাকশী সেই প্রমাণ রেখে গেছে।
হারুন হাকশী খানিকক্ষণ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাদের লক্ষ করল, তারপর খসখসে রুক্ষ গলায় বলল, লেসার বীম দিয়ে তোমাদের মাঝে কে আমার ফোবোসে আঘাত করেছিলে?
ফোবোস মানে?
ফোবোস হচ্ছে এই মহাকাশযান। পৃথিবীর মানুষেরা যেটাকে ফ্লাইং সসার ভেবে ভয়ে ভিরমি খাচ্ছে।
ও। জাহিদ তাচ্ছিল্যের স্বরে জিজ্ঞেস করল, লেসার বীম তেমন ক্ষতি করতে পারে নি তা হলে?
ক্ষতি যা করার ঠিকই করেছে তিন ইঞ্চি ব্যাসের ফুটো করে ফেলেছে আগাগোড়া, কিন্তু ঠিক করে ফেলতে সময় লেগেছে মাত্র চব্বিশ ঘন্টা। কে আঘাত করেছিলে, তুমি?
জাহিদের খুব লোভ হচ্ছিল, সে প্রশংসাটুকু নিয়ে হাকশীকে একটু ভয় পাইয়ে দেয়। কিন্তু কী ভেবে সত্যি কথাই বলল। আঘাত আমরা কেউ করি নি, করেছিলেন হাসান স্যার।
কোথায় সে।
এড্রোমিডাতে শেষ পর্যন্ত ছিলেন।
ও। ভালোই লক্ষ্যভেদ করেছিল, প্রশংসা করতে হয়। কিন্তু আমার বিরুদ্ধে লেসার বীম নিয়ে লড়তে আসা ছেলেমানুষি—
কামাল চটে উঠে বলল, ঐ ছেলেমানুষি অস্ত্রই তো তোমার ফোবোসের বারটা বাজিয়ে দিয়েছিল।
কক্ষণো না। ওটা কোনো আঘাতই হয় নি। দেখতে দেখতে আমার টেকনিশিয়ানরা সেরে ফেলেছিল।
আর যারা মারা গেছে, জাহিদ জিজ্ঞেস না করে পারল না; তাদেরকেও কি দেখতে দেখতে প্রাণ দিয়ে দিয়েছ?
হাকশী চমকে উঠে বলল, মারা গেছে, তুমি কেমন করে জানলে?
জাহিদ নির্দোষ মুখে বলল, জানতাম না, এখন জানলাম।
হাকশীর মুখে হাসি ফুটে ওঠে। জাহিদের দিকে এগিয়ে এসে বলল, তুমি তো বেশ বুদ্ধিমান দেখছি। কী কর তুমি?
তুমি শুনে কী করবে?
হাকশীর হাসি এক মুহূর্তে মুছে গেল। থমথমে গলায় বলল, শুনবে কী করব?
কী?
তোমাদের এক্ষুণি মেরে বাইরে ফেলে দেব, না আরও কয়েকটা দিন বাচিয়ে রাখব, সেটা ঠিক করব।
জাহিদ শান্ত স্বরে বলল, মেরে ফেলার হলে আগেই মেরে ফেলতে, কষ্ট করে দেয়াল কেটে বের করে আনতে না।
হ্যাঁ—কিন্তু দেয়াল কেটে বের করে এনে যদি দেখি কয়েকটা নিষ্কর্মা বুদ্ধিজীবী নিয়ে এসেছি—ছুঁড়ে ফেলে দেব মহাকাশে। বল, তুমি কী কর?
আমি একজন পদার্থবিজ্ঞানী। জাহিদ ঠান্ডা স্বরে বলল, তাত্ত্বিক নিউক্লিয়ার ফিজিক্সে গত বছর ডক্টরেট করেছি।
চমৎকার। হাকশীর মুখে হাসি ফুটে ওঠে। তোমাকে আমার দরকার। বেঁচে গেলে এবার!
হাকশী এবার কামালের দিকে তাকাল। জিজ্ঞেস করল, তুমিও কি পদার্থবিজ্ঞানী?
না। আমি নিউক্লিয়ার রি-অ্যাক্টর-ইঞ্জিনিয়ার।
কয় বছরের অভিজ্ঞতা আছে?
বেশি না। পাঁচ বছর।
ভেরি গুড। তোমাকে আমার আরও বেশি দরকার। আর এই যে মেয়ে, তুমি কী কর?
আমি জীববিজ্ঞানী। গত বছর ডক্টরেট করেছি মাইক্রো—ঠোট উল্টাল, হাকশী বলল, তোমাকে আমার দরকার নেই।
জেসমিন ফ্যাকাসে হয়ে উঠল। জাহিদ তীব্র স্বরে চেঁচিয়ে উঠে বলল, মানে?
মানে অতি সহজ। এই মেয়েটির আমার কোনো দরকার নেই। ওকে এক্ষুণি মহাকাশে ফেলে দেয়া হবে—না-না, ঘাবড়ানোর কিছু নেই। আমি এমনিতে জ্যান্ত মানুষ মহাকাশে ফেলে দিই না—তার আগে—এখানেই তাকে মেরে নেয়া হবে।
লোকটা ঠাট্টা করছে, না সত্যি সত্যি জেসমিনকে এখানে মেরে ফেলতে চাইছে, জাহিদ প্রথমে বুঝতে পারল না। যখন বুঝতে পারল সত্যি সত্যি সে জেসমিনকে এখানেই গুলি করতে চায়—চিৎকার করে হাকশীর দিকে ছুটে গেল, তুমি পেয়েছটা কি? ভেবেছ—আমরা বেঁচে থাকতে তুমি ওর গায়ে হাত তুলতে পারবে?
কামাল জেসমিনকে আড়াল করে দাঁড়িয়ে বলল, ওকে মারতে চাইলে আগে আমাদের মারতে হবে। আর যদি আমাদের বাঁচিয়ে রাখতে চাও, জেসমিনকেও বাঁচিয়ে রাখতে হবে।
হাকশী একটু অবাক হল মনে হল। খানিকক্ষণ চপচাপ দাঁড়িয়ে বলল, বেশ, এবারে বেঁচে গেলে জেসমিন না কী যেন নাম তোমার। কিন্তু আমার এখানে কেউ চুপচাপ থাকতে পারে না—একটা-না-একটা কাজ করতে হবে বলে রাখলাম।
জাহিদ ভুরু কুঁচকে বলল, আর যদি না করি?
ঘর ফাটিয়ে হেসে উঠল হাকশী। হাসতে হাসতে বলল, তোমার সাহস তো মন্দ নয় ছেলে। আমার এখানে থাকবে অথচ কাজ করবে না? দেখাই যাক না কাজ নাকরে পার কি না!
কামাল চাপা স্বরে বলল, তোমার নিজের উপর বিশ্বাস খুব বেশি মনে হচ্ছে।