জেসমিন উত্তর দিল, অনিশ্চিত অবস্থা কখনো ভালো লাগার কথা নয়, কিন্তু পৃথিবীর সবাই আমাদের জন্যে অনুভব করছে ভেবে খুব ভালো লাগছে।
ফ্লাইং সসার সম্পর্কে আপনাদের কী অভিমত?
এটা আসলে ফ্লাইং সসার কি না সে সম্পর্কে নিশ্চিত না হয়ে কিছু বলা যাবে না। তবে এটি যাই হোক না কেন, তার উদ্দেশ্য ভালো নয়।
কামাল উত্তপ্ত হয়ে বলল, যদি ধ্বংস না হয়ে থাকে তবে ওটাকে যেভাবে হোক ধ্বংস করতে হবে।
আপনারা কি মনে করেন, এন্ড্রোমিডার অধিপতি হাসান ওটাকে ধ্বংস করতে পেরেছেন?
আমাদের মনে করা না-করায় কিছু আসে যায় না। তবে হাসান স্যার ওটাকে আঘাত করতে পেরেছেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। পৃথিবীর অনেক দেশেরই কৃত্রিম গ্রহ এবং উপগ্রহ রয়েছে, যেগুলিতে ভয়ানক সব পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে। সেগুলি কি ফ্লাইং সসারকে আঘাত করতে পারত না?
জাহিদ সাবধানে উত্তর দিল। বলল, ফ্লাইং সসারটিকে রাডারে খুব কাছে না আসা পর্যন্ত দেখা যায় না। তাই হাসান স্যারের আগে আর কেউ এটাকে আঘাত করতে পারে নি।
এন্ড্রোমিডার অধিনায়ক হাসান সম্পর্কে কিছু বলবেন কি?
কামাল ভারী গলায় বলল, হাসান স্যার সম্পর্কে বলতে হলে আধ ঘন্টার অনুষ্ঠান যথেষ্ট নয়—কয়েক যুগব্যাপী অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে হবে। পৃথিবীর সবচেয়ে খাটি মানুষ হাসান স্যার–
জাহিদ বাধা দিয়ে বলল, হাসান স্যারের কথা প্রসঙ্গে আমার একটি কথা মনে। হল। স্যার আমাকে একটা চিঠি দিয়েছেন পৃথিবীতে পৌঁছে দেবার জন্যে। স্যার মারা যাবার পর চিঠিটা আমি খুলে পড়েছি পৃথিবীতে পাঠানোর জন্যে। আপনাদের আবার পড়ে শোনাচ্ছি।
মহাকাশ বিজ্ঞান সর্বাধিনায়ক।
আমার সুদীর্ঘ চাকরিজীবনে আমি যে পারিশ্রমিক পেয়েছি এবং বিভিন্ন জাতীয় পুরস্কারে আমার যে-অর্থপ্রাপ্তি হয়েছে তার পুরোটুকু জাতীয় অনাথাশ্রমে দিয়ে দিলে বাধিত হব।
বিনীত—
হাসান।
আপনারা নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন, একজন মানুষ কতটুকু মহান হলে মৃত্যুর পূর্বমুহূর্তে এরকম চিঠি লিখে যেতে পারে—
সর্বনাশ! জেসমিন চিলের মতো তীক্ষ্ম স্বরে চিৎকার করে উঠল-চিৎকার শুনে জাহিদ আর কামালের সাথে সাথে পৃথিবীর তিন শত কোটি মানুষ একসাথে চমকে উঠল।
রাডার স্ক্রীনের দিকে তাকিয়ে কামাল ফ্যাকাসে রক্তশূন্য মুখে বলল, ফ্লাই-ইং- স-সার!!
পরবর্তী তিরিশ সেকেণ্ড সবাই ওদের তিনজনকে প্রচণ্ড বিস্ফোরণে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবার ভয়াবহ দৃশ্য দেখার আশঙ্কায় রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করতে থাকে। কিন্তু কিছুই ঘটল না। জাহিদ কাঁপা গলায় বলল, আমরা আর কতক্ষণ বেঁচে থাকব জানি না। ফ্লাইং সসারটিকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। যে-কোনো মুহূর্তে আমাদের আঘাত করতে পারে—আমাদের কিছু করার নেই। ওটা এখন খুব কাছে চলে এসেছে। সোজা আমাদের দিকে আসছে। কোথাও এত কাছে কখনও এটি আসে নি। আমরা ওটাকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। কুৎসিত ধাতব একটি চাকতির মতো, উপরে গোল গোল বৃত্ত—বোধ করি জানালা। তিন পাশ দিয়ে নীলাভ আগুন বেরুতে থাকে। প্রচণ্ড বেগে ঘুরতে ঘুরতে এগিয়ে আসছে।
জাহিদ জিব দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে বলল, ওটা আরও কাছে এগিয়ে আসছে। আমাদের আঘাত করার বোধ করি কোনো ইচ্ছে নেই কিন্তু কী করতে চাইছে বুঝতে পারছি না। আরো কাছে এসেছে—আরো কাছে আরো কাছে—
টেলিভিশনের স্ক্রীন বারকয়েক কেঁপে স্থির হয়ে গেল। সুদর্শন ঘোষক এসে স্নান মুখে বলল, তিনজন তরুণ-তরুণীর ভাগ্যে কী ঘটেছে আমরা বলতে পারছি না। মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র থেকে খবর আসামাত্রই আপনাদের জানানো হবে। এখন দেখুন ছায়াছবি রবোটিক ম্যান।
পৃথিবীর তিন শ’ কোটি মানুষ বসে বসে বিরক্তিকর ছায়াছবি রবোটিক ম্যান দেখতে লাগল।
পরদিন ভোরে পৃথিবীর মানুষ খবর পেল জাহিদ, কামাল আর জেসমিনকে ফ্লাইং সসারের প্রাণীরা ধরে নিয়ে গেছে। ওদের শূন্য রকেটটি পৃথিবীতে ফিরে এসেছে। রকেটের দেয়াল গোল করে কাটা।
ফ্লাইং সসারের দেয়ালে পিঠ দিয়ে ওরা তিনজন প্রায় মিনিট সাতেক হল দাঁড়িয়ে আছে। ওদেরকে যেভাবে রকেট থেকে টেনে বের করে আনা হয়েছে—একটু ভুল। হলেই ওরা মারা যেতে পারত। ফ্লাইং সসারটি রকেটের গায়ে স্পর্শ করে ও ধারদেয়াল কেটে বাতাসের চাপকে ব্যবহার করে ওদের তিনজনকে টেনে এনেছে। ওদের সাথে সাথে রকেটের ভেতরকার অনেক টুকরো টুকরো ছোটখাটো যন্ত্রপাতি খুচরা জিনিসপত্র এখানে চলে এসেছে। কামাল তার ভেতর থেকে বেছে বেছে একটা শক্ত লোহার রড হাতে নিয়ে অপেক্ষা করছে—ফ্লাইং সসারের অধিবাসীদের বিপজ্জনক কিছু করতে দেখলে একবার শেষ চেষ্টা করে দেখবে?
জাহিদ অনেকক্ষণ হল ধাতব দেয়ালটি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করছিল। কী দেখে কামালকে ডেকে বলল, কামাল, এই স্কুটা দেখে তোর কী মনে হয়?
কামাল উত্তেজিত হয়ে বলল, আরে! এটা তো ফাইভ পয়েন্ট ফাইভ স্কু! পৃথিবীর তৈরি জিনিস!
জেসমিন অবাক হয়ে বলল, মানে?
মানে এটা পৃথিবীতে তৈরি। পৃথিবীর মানুষের কারসাজি। নিশ্চয়ই কিছু পাজি লোক মিলে তৈরি করেছে।
শুধু পাজি বলিস না জাহিদ বাধা দিয়ে বলল, পাজি এবং প্রতিভাবান। যেসব ইঞ্জিনিয়ারিং খেল দেখাচ্ছে, মাথা খারাপ হয়ে যাবার জোগাড়।
হাতে পেলে টুটি ছিড়ে ফেলতাম—
সাথে সাথে খুট করে একটা দরজা খুলে গেল এবং একজন দীর্ঘ লোককে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল। দুই পাশ থেকে দু’ জন লোক হাতে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র নিয়ে প্রথমে ঘরে ঢুকে ঘরের দু’পাশে দাঁড়িয়ে পড়ল। কামালকে ইঙ্গিত করল হাতের রডটা ফেলে দিতে। কামাল নীরস মুখে রডটা ছুঁড়ে দিতেই দীর্ঘ লোকটি এসে ঢুকল।