তিরিশ মিনিট পর দেখা গেল লেসার টিউব নির্দিষ্ট দিকে তাক করে রেখে হাসান চুপ করে বসে আছে। হাতে সিগারেট, মাথার উপরে ঘড়ি, লাল কাঁটাটা বার’র উপরে আসতেই তাকে সুইচ টিপে প্রচণ্ড শক্তিশালী লেসার বীম পাঠাতে হবে। অদৃশ্য সেই সসারকে ফুটো করে দেবে সেই রশ্মি! তারপর?
তারপর হাসান আর ভাবতে চায় না ফ্লাইং সসারের পাল্টা আঘাতে তার কি হবে ভেবে কী লাভ?
একত্রিশ মিনিট পর জাহিদ কাউন্টারগুলি থেকে চোখ ফিরিয়ে এনে কাঁপা গলায় বলল, আমার হিসেবে ভূল না হয়ে থাকলে এড্রোমিডা এ মূহূর্তে ধ্বংস হয়ে গেল।
জাহিদ, কামাল আর জেসমিন এগ্রোমিডা ছেড়ে এসেছে প্রায় চব্বিশ ঘন্টা আগে। এই চৰ্বিশ ঘন্টার প্রতিটি মুহূর্ত তারা অবর্ণনীয় আতঙ্কের মাঝে কাটিয়েছে। এর আগে এগ্রোমিডাতে হাসান তাদের সব বিপদে-আপদে আগলে রেখেছিল, কিন্তু এখন এই নিঃসঙ্গ মহাকাশযানে তারা সত্যিকার অসহায়। মানসিকভাবে একটা অস্বাভাবিক অবস্থার মাঝে রয়েছে বলে হাসানের জন্যে দুঃখবোধটাও তেমন যন্ত্রণা দিতে পারছে না
পৃথিবীতে পৌঁছুতে তাদের আরো আটচল্লিশ ঘণ্টারও বেশি সময় লাগবে। যদি এর আগেই ফ্লাইং সসার আক্রমণ করে বসে তাহলে অবশ্য ভিন্ন কথা। কিন্তু ওরা খানিকটা আশাবাদী, কারণ গত চব্বিশ ঘন্টায় আর একটি মহাকাশযানও নূতন করে ধ্বংস হয়নি। বোঝাই যাচ্ছে হাসানের লেসার রশ্মি সত্যি সত্যি ফ্লাইং সসারকে আঘাত করতে পেরেছিল। কিন্তু আঘাতের পর ফ্লাইং সসার নিজেই ধ্বংস হয়ে গেছে, না শুধুমাত্র অল্প কিছু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সেটা এখনো বলা যাচ্ছে না। পৃথিবীর সবাই আশা করছে ফ্লাইং সসার ধ্বংস হয়ে গেছে, যদিও মহাকাশযানে এই নিঃসঙ্গ তিনজন ঠিক ততটা বিশ্বাস করতে পারছে না। জাহিদ প্রতি মুহূর্তে পৃথিবীর সাথে আলাপ করছে, রকেটে করে দূরপাল্লার পাড়ি দেয়ার সময় এর আগে তার কখনো নেতৃত্ব দিতে হয় নি। কামাল সতর্ক দৃষ্টিতে রাডারগুলির দিকে নজর রাখছে। যদিও রাডারে ফ্লাইং সসার ধরা পড়লে তাদের কিছু করার নেই, কিন্তু তবুও সে নিজের চোখে জিনিসটা দেখতে চায়। জেসমিনের আপাতত কিছু করার নেই। মনে মনে খোদাকে ডেকে আর হাসানের কথা ভেবে কষ্ট পেয়ে সে সময় পার করছিল।
পৃথিবীতে মহাকাশের সর্বশেষ খবর পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে জরুরি বেতার আর টেলিভিশনে করে প্রচারিত হচ্ছিল। হাসানের ফ্লাইং সসারকে পাল্টা আঘাত করে আত্মত্যাগ করার খবর পৃথিবীতে প্রচণ্ড আলোড়নের সৃষ্টি করেছে। দেশ থেকে তাকে মরণোত্তর সর্বোচ্চ পদক দিয়ে সম্মান করা হয়েছে। হাসানের সাথে সাথে জাহিদ, কামাল আর জেসমিনের নামও পৃথিবীর সবার জানা হয়ে গেছে। এই তিনজন অনভিজ্ঞ তরুণ-তরুণী কিভাবে সময় কাটাচ্ছে, পৃথিবীতে ফিরে আসতে আর কতক্ষণ সময় বাশি রয়েছে, এইসব খবরাখবর খানিকক্ষণ পরেপরেই নিউজ বুলেটিনে প্রচারিত হচ্ছিল।
ছত্রিশ ঘন্টার মাথায় পৃথিবী থেকে জাহিদকে জানানো হল, পৃথিবীবাসীর অনুরোধে আধ ঘন্টা সময় তাদেরকে সরাসরি পৃথিবীর সব টেলিভিশনে দেখানো হবে। তারা কী করছে না-করছে সে সম্পর্কে পৃথিবীর মানুষ আগ্রহী। কয়েকজন বিখ্যাত সাংবাদিক মহাকাশ স্টেশনে তাদের সাথে আলাপ করার জন্যে যাবে। মহাকাশ স্টেশন থেকে ওদের বারবার বলে দেয়া হল কোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে খুব সতর্ক থাকতে। দেশ এবং জাতির সম্মান জড়িত রয়েছে ওদের উপর।
নির্দিষ্ট সময়ের অনেক আগেই তারা খুব নার্ভাস হয়ে পড়ল। জাহিদ কিংবা কামাল এর আগে কখনোই রেডিও বা টেলিভিশনের সামনে সাক্ষাৎকার দেয় নি। জেসমিন সাক্ষাৎকার না দিলেও ছেলেবেলায় টেলিভিশনে নিয়মিত বিজ্ঞানের উপর অনুষ্ঠান করত। কিন্তু এবারের এটি একটি সম্পূর্ণ ভিন্ন ব্যাপার। সমস্ত পৃথিবীর মানুষ একই সাথে তাদেরকে দেখবে, তাদের কথাবার্তা শুনবে। ঠিক কীভাবে থাকতে হবে, কী বলতে হবে, এরা ঠিক বুঝতে পারছিল না। অনুষ্ঠান শুরুর আগে আগে তারা চুলগুলি আঁচড়ে নিয়ে নার্ভাস হয়ে অপেক্ষা করতে লাগল।
পৃথিবীর সব টেলিভিশনে গত কয়েক ঘন্টা থেকে এই অনুষ্ঠানটির সম্পর্কে। ঘোষণা করা হচ্ছে। নির্দিষ্ট সময়ে পৃথিবীর তিন শ’ কোটি লোকের প্রায় সবাই টেলিভিশনের সামনে আগ্রহ নিয়ে বসে রইল। প্রথমে ঘোষক এসে জানিয়ে গেল মহাকাশ থেকে টেলিভিশনে পাঠানো অনুষ্ঠানটি সরাসরি পৃথিবীতে প্রচার করা হচ্ছে। অনুষ্ঠান পরিচালনায় সাহায্য করছেন পৃথিবীর নামকরা কয়জন সাংবাদিক। ধীরে ধীরে টেলিভিশনের স্ক্রীনে একটা ছুঁচালো সিলিন্ডারের মতো মহাকাশযানের ছবি ভেসে উঠল। যদিও সেটি স্থির হয়ে রয়েছে—কিন্তু আসলে এটি ঘন্টায় চল্লিশ হাজার মাইল বেগে ছুটে আসছে। আস্তে আস্তে মহাকাশযানটি ঝাপসা হয়ে গেল, তার জায়গায় ফুটে উঠল যন্ত্রপাতিসমৃদ্ধ মহাকাশযানটির কন্ট্রোল রুম—তিনজন তরুণ-তরুণী সেখানে চুপচাপ অপেক্ষা করে রয়েছে। ইঙ্গিত পাওয়ামাত্র জাহিদ সোজা হয়ে বসে ধীরে ধীরে বলল, নিঃসঙ্গ মহাকাশযানের তিনজন নিঃসঙ্গ তরুণ-তরুণী পৃথিবীর মানুষকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছে।
আপনাদের সাথে আমি এই মহাকাশযানের অভিযাত্রীদের পরিচয় করিয়ে দিই।
জাহিদ খুব দক্ষতার সাথে পরিচয়পর্ব শেষ করল। সাথে সাথেই একজন সাংবাদিক পৃথিবী থেকে জিজ্ঞেস করল, অনিশ্চিত অবস্থা আপনাদের কেমন লাগছে?