জ্বি স্যার।
কি?
আমার মনে হয় মহাকাশযানটি কোনো নিউক্লিয়ার এক্সপ্লোশানে ধ্বংস হয়েছে। হাসান চমকে উঠে জিজ্ঞেস করল, একথা বলছ কেন?
ঘন্টাখানেক আগে মহাকাশের তেজস্ক্রিয়তা হঠাৎ করে বেড়ে গেছে। হিসেব করে দেখেছি মহাকাশযানটি যতদূরে রয়েছে সেখানে কোনো ছোট পারমাণরিক বিস্ফোরণ ঘটলে এটুকু হওয়া উচিত।
হাসান বুঝতে পারল, ছেলেটা ঠিকই ধরেছে, কিন্তু এ ব্যাপারে যুক্তি দিয়ে অগ্রসর হওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই, যখন নিশ্চিত হবার মতো ব্যবস্থা রয়েছে।
ঘন্টাখানেক পরে একগাদা আলোকচিত্র নিয়ে হাসান তার কেবিনে ছটফট করছিল। জাহিদের ধারণা সত্যি। মহাকাশযানটি পারমাণবিক বিস্ফোরণে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। আটজন ক্রু নিয়ে এরকম দুর্ঘটনা গত দশ বছরে আর একটিও হয় নি। পৃথিবীতে খবর পাঠানো হয়েছে—কীভাবে দুর্ঘটনা ঘটল ব্যাপারটি দেখার জন্যে একটা ছোট রকেট সিগনাস’ পাশের মহাকাশ স্টেশন থেকে রওনা হয়ে গেছে।
জাহিদ, কামাল আর জেসমিন খুব মুষড়ে পড়েছে। হাসান ওদের নানাভাবে চাঙ্গা করার চেষ্টা করছিল, কিন্তু কোনো লাভ হয় নি।
বিছানায় শুয়ে হাসান খুব ক্লান্তি অনুভব করে। তার নার্ভ আর সইতে পারছে না। কোনো এক নীল হ্রদের পাশে মাটির কাছাকাছি ঘাসে শুয়ে থেকে থেকে আকাশে সাদা মেঘ দেখার জন্যে ওর বুকটা হা-হা করতে থাকে।
পরদিন ভোরে হাসান খুব আশ্চর্য একটি খবর পেল। খবরটি প্রথমে জানাল জাহিদ। তার নিজস্ব হিসেব অনুযায়ী মহাকাশে তাদের কাছাকাছি নাকি আরও তিনটি পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটেছে।
সকালের রিপোর্ট পৌঁছুতেই দেখা গেল জাহিদের ধারণা সত্যি। গত বার ঘন্টায় সর্বমোট পাঁচটি মহাকাশযান পারমাণবিক বিস্ফোরণে ধ্বংস হয়েছে, তার ভিতরে তিনটি তাদের কাছাকাছি, লক্ষ মাইলের ভিতরে। এই পাঁচটি মহাকাশযান ভিন্ন ভিন্ন পাঁচটি দেশের এবং তারা ভিন্ন ভিন্ন কাজে ব্যস্ত ছিল। পাঁচটি মহাকাশযানে দুই শতাধিক প্রথমশ্রেণীর টেকনিশিয়ান, ইঞ্জিনিয়ার আর বিজ্ঞানী কাজ করছিল সবাই মর্মান্তিকভাবে মারা গেছে।
কন্ট্রোলরুমে হাসান চুপচাপ বসে রইল। সে চোখ বন্ধ করে দেখতে পাচ্ছে, সমস্ত পৃথিবীতে কী ভয়ানক আলোড়ন সৃষ্টি হয়ে গেছে। খবরের কাগজ, রেডিও, টেলিভিশন কী সাংঘাতিক হৈচৈ শুরু করেছে। কিন্তু এরকম হচ্ছে কেন?
জেসমিন স্নানমুখে বসে ছিল—অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে ধীরে ধীরে বলল, আমার ভালো লাগছে না কেন জানি মনে হচ্ছে একটা ভীষণ বিপদ ঘটতে যাচ্ছে।
হাতে মুঠি করে ধরে রাখা কাগজ খুলে কম্পিউটারের ডাটা দেখতে দেখতে জাহিদ বলল, আমার হিসেবে ভুল না হয়ে থাকলে আরো দু’টি মহাকাশযান ধ্বংস হয়েছে।
সত্যতা যাচাই করে নেবার উৎসাহ পর্যন্ত কেউ দেখাল না। বুঝতে পারল, সত্যিই তাই ঘটেছে।
» ২. সব কয়টি চ্যানেল চালু রেখে
হাসান সব কয়টি চ্যানেল চালু রেখে যতগুলি সম্ভব মহাকাশযানের সাথে যোগাযোগ রেখে চলল। অনেক কয়টা মহাকাশযান পৃথিবীতে নেমে পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের বড় বড় দু’টি মহাকাশ ল্যাবরেটরি খালি করে সব কয়জন বিজ্ঞানী আর টেকনিশিয়ান পৃথিবীর দিকে ফিরে গেল। যারা পৃথিবী থেকে দূরে—কিংবা পৃথিবীতে ফিরে যেতে পারছিল না, তারা ভীষণ অসহায় অনুভব করতে লাগল। কারণ গড়ে প্রতি দুই ঘন্টায় একটা করে মহাকাশ স্টেশন ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। সবাই ধারণা করে নিয়েছে, একটা অজ্ঞাত কোনো মহাকাশযান একটি একটি করে পৃথিবীর সবকয়টি মহাকাশযান ধ্বংস করে যাচ্ছে। প্রথমে জল্পনাকল্পনা এবং ধারণা, কিন্তু চৰ্বিশ ঘন্টার মাথায় দেখা গেল ব্যাপারটা আসলেও তাই।
জাপানের একটি উপগ্রহ ধ্বংস হয়ে যাবার পূর্বমুহূর্তে একজন বিজ্ঞানীকে চিৎকার করে বলতে শোনা গেল—’ফ্লাইং সসার’!
পৃথিবী থেকে সবাইকে মহাকাশযানগুলি খালি করে পৃথিবীতে চলে আসার নির্দেশ দেয়া হল। যারা অনেক দূরে কিংবা যাদের এই মুহূর্তে পৃথিবীতে ফিরে আসা সম্ভব নয়, তাদেরকে বিশেষ নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নেয়ার আদেশ দেয়া হল।
হাসান পৃথিবীতে ফিরে যাওয়ার জন্যে ছোট্ট রকেটটাতে জ্বালানি ভরে নিয়ে যন্ত্রপাতি পরীক্ষা করে নিল, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তারা পৃথিবীতে রওনা দেবে। সারাদিনের উত্তেজনায় জাহিদ, কামাল আর জেসমিন বিপর্যস্ত। হাসান জোর করে ঘন্টাখানেকের জন্যে বিশ্রাম নিতে পাঠিয়েছে। একেকজন এত ক্লান্ত যে মড়ার মতো ঘুমাচ্ছে।
হাসান তার মহাকাশ স্টেশনে সব কয়টি রাডার চালু করে রেখেছে, যদিও জানে তাতে কোনো লাভ নেই। এ পর্যন্ত যে কয়টি মহাকাশযান ধ্বংস হয়েছে তাদের ভিতরে কেউ সতর্ক হবার এতটুকু সুযোগ পায় নি, যদিও সবার কাছেই সর্বাধুনিক রাডার ছিল। খুব কাছে আসার পর হয়তো সেটিকে দেখা যায়, কিন্তু ততক্ষণে কিছু করার থাকে না। এণ্ড্রোমিডাতে নূতন ধরনের অনেকগুলি রাডার স্টেশন ছিল, যেগুলি আন্তঃসৌরমণ্ডল যোগাযোগে সাহায্য করার জন্যে আনা হয়েছিল। এগ্রোমিডা ছেড়ে চলে যেতে হবে শোনার পর হাসান এই মূল্যবান ক্ষুদ্রকায় কিন্তু প্রচণ্ড ক্ষমতাবান রাডার স্টেশনগুলি এগ্রোমিডাকে ঘিরে চারদিকে পাঠিয়ে দিয়েছে। যদি ভাগ্য ভালো হয়, হয়তো তাদের কোনো একটি এই রহস্যময় ফ্লাইং সসারকে দেখতে পেয়ে তাকে সতর্ক করে দিতে পারবে।
পৃথিবীর দিকে রওনা দেবার আর দেরি নেই। জ্বালানি নিয়ে নেয়া হয়েছে, স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রপাতি কাজ করতে শুরু করেছে। আর ঘন্টাখানেক পরেই ইচ্ছে করলে রওনা দেয়া সম্ভব—যদি-না এর মাঝেই সেই ফ্লাইং সসার এসে হানা দেয়!