এতক্ষণ পর হাকশীর মুখের ভাব সহজ হয়ে আসে। সে হাসিমুখে অনেকক্ষণ সময় নিয়ে একটা সিগারেট ধরায়, তারপর ঠাণ্ডা গলায় বলে, তোমরা বুদ্ধিমান ছেলে! নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ আমি কী করতে চাইছি।
কামাল আর জাহিদ কোনো কথা বলল না। তীব্র দৃষ্টিতে হাকশীর দিকে তাকিয়ে রইল।
হাকশী ঘরে হেঁটে বেড়াতে বেড়াতে অনেকটা আপন মনে বলতে থাকে, প্রথমে ভেবেছিলাম তোমাদের উপরই পরীক্ষাটা চালাব। কাউকে কোনো কিছু স্বীকার করানোর জন্যে প্রাচীনকালে কিছু কিছু পদ্ধতি ব্যবহার করা হত। যেমন নখের নিচে গরম সুচ ঢুকিয়ে দেয়া, লোহার শিক গরম করে শরীরের বিশেষ বিশেষ জায়গায়। ছ্যাকা দেয়া, পা বেধে উপর থেকে ঝুলিয়ে রাখা, পানির বালতিতে মাথা ডুবিয়ে রাখা ইত্যাদি ইত্যাদি। এ ছাড়া আরও বীভৎস পদ্ধতি আছে, যেমন শরীর ছিড়ে সেখানে অ্যাসিড লেপে দেয়া, সীসা গরম করে কানে ঢেলে দেয়া, সাঁড়াশি দিয়ে একটা করে দাঁত তুলে নেয়া, আলপিন দিয়ে চোখ গলিয়ে দেয়া ইত্যাদি ইত্যাদি। বলে এগুলি শেষ করা যায় না।
হাকশী তার বক্তৃতার ফলাফল দেখার জন্যে একবার আড়চোখে ওদের দুজনকে দেখে নিল, তারপর আবার বলতে শুরু করল, প্রথমে ভেবেছিলাম তোমাদের দু’জনের উপর এই পদ্ধতিগুলি ব্যবহার করে নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টর সারিয়ে নেব। কিন্তু পরে। মনে হল, তোমরা যেরকম একগুঁয়ে, হয়তো দাঁত কামড়ে মরে যাবে তবু রাজী হবে না। তখন এই মেয়েটার কথা মনে হল। মনে আছে প্রথম যেদিন ওকে মেরে ফেলতে চেয়েছিলাম, ওর জন্যে তোমাদের দরদ কেমন উথলে উঠেছিল?
হারামজাদা—শুওরের বাচ্চা। কামালের মুখ টকটকে লাল হয়ে উঠল রাগে।
মিছিমিছি কেন মুখ খারাপ করছ ইঞ্জিনিয়ার সাহেব—লাভ নেই কিছু। তার চেয়ে আমার কথা শোন। আমি যদি তোমাদের সামনে এই মেয়েটার গায়ে হাত দিই, তোমাদের কেমন লাগবে? যদি মনে কর নখের নিচে সুচ ঢুকিয়ে দিই? কিংবা ঝুলিয়ে রেখে চাবুক মারি—
মেরে দেখ না কুত্তার বাচ্চা—তোর গুষ্টি যদি আমি–
হাকশী হা-হা করে হেসে উঠল। বলল, রক্ত গরম তোমার কামাল সাহেব। মাথা ঠাণ্ডা রাখ। আমি ইচ্ছে করলে এখন এই মেয়েটার শরীর চাকু দিয়ে চিরে ফেলতে পারি, চোখ তুলে ফেলতে পারি, দাঁত ভেঙে ফেলতে পারি—তোমাদের বসে দেখতে হবে। পারবে?
শুওরের বাচ্চা!
আমার কথার উত্তর দাও। পারবে দেখতে? একটু থেমে বলল, পারবে না। এসব দৃশ্য দেখতে ভালো লাগে না—বিশেষ করে যদি সেটি কোনো পরিচিত মেয়ের উপর করা হয়। কাজেই আমার প্রস্তাবটা শোন—এই মুহূর্তে তোমরা দু’ জন নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টর দু’টি ঠিক করে দাও। যদি রাজি না হও, তাহলে হাকশী দাঁত বের করে হাসল।
জেসমিন এতক্ষণ একটি কথাও বলছিল না। এবারে কান্নায় ভেঙে পড়ল। ভাঙা গলায় বলল, তোমরা ওর কথায় রাজি হয়ো না। ও একটা পিশাচ। আমার জন্যে ভেবো না—যা হবার হবে! তোমরা কিছুতেই ওর কথায় রাজি হয়ো না।
হাকশী দু’ পা এগিয়ে আসে। মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, তোমার জন্যে ভাবতে নিষেধ করছ? অত্যাচার সহ্য করতে পারবে তাহলে?
জেসমিন ভীত চোখে তাকাল হাকশীর দিকে। হাকশী আরো ঝুঁকে পড়ে ওর দিকে। হাতের সিগারেটটা তুলে ধরে বলে, পরীক্ষা হয়ে যাক একটা, দেখি কতটুকু সহ্যক্ষমতা।
খবরদার। কামালের চিৎকারে সারা ঘর কেঁপে উঠল, কিন্তু হাকশীর মুখের মাংসপেশী এতটুকু নড়ল না। হাসিমুখে সিগারেটের আগুনটা জেসমিনের গলায় চেপে ধরল।
বন্ধ কর—বন্ধ কর বলছি শুওরের বাচ্চা, নইলে প্রচন্ড ক্রোধে কামাল কথা বলতে পারে না।
জেসমিন শিউরে উঠে চোখ বন্ধ করল। প্রচণ্ড যন্ত্রণায় ঠোট কামড়ে ধরল। মুহূর্তে ওর সারা মুখ টকটকে লাল হয়ে ওঠে আর বিন্দু বিন্দু ঘামে ভিজে ওঠে। কুঁচকে ওঠা চোখের ফাঁক দিয়ে উষ্ণ পানির ফোঁটা গড়িয়ে পড়ে আর সে প্রচণ্ড যন্ত্রণাকে সহ্য করার জন্যে প্রাণপণে ঠোঁট কামড়ে ধরে। ঠোঁট কেটে দু ফোঁটা রক্ত ওর চিবুক বেয়ে গড়িয়ে পড়ল—পোড়া মাংসের একটা মৃদু গন্ধ ঘরে ছড়িয়ে পড়ল ধীরে ধীরে।
কামাল চোখ বন্ধ করে দাঁতে দাঁত চেপে বসে নিজের ভিতরের প্রচণ্ড আক্রোশটা আটকে রাখতে চাইছিল। এবারে আর সহ্য করতে না পেরে চিৎকার করে উঠল, ঠিক আছে শুওরের বাচ্চা, আমি রাজি।
হাকশীর মুখের হাসিটা আরো বিস্তৃত হয়ে উঠল, এই তো বুদ্ধিমান ছেলের মতো কথা। সে সিগারেটটা সরিয়ে এনে সেটাতে একটি টান দিয়ে ওদের দিকে এগিয়ে আসে, তাহলে এখনই কাজে লেগে যাও!
এখন পারব না। জাহিদ শীতল স্বরে বলল, বিশ্রাম নিতে হবে, কাল ভোরের আগে সম্ভব না।
বেশ। তাহলে বিশ্রাম নাও। কাল দশটার ভেতরে আমি সবকিছু ঠিকঠাক দেখতে চাই
মামাবাড়ির আবদার পেয়েছ? একটা জিনিসের বারটা বাজাতে দু মিনিট লাগে কিন্তু সেটা ঠিক করতে দু’ বছর লেগে যায়, জান না?
সে আমার জানার দরকার নেই। দশটার ভেতর ঠিক করে যদি না দাও তোমাদের জেসমিনকে আস্ত দেখতে পাবে না।
হাকশী। বাজে কথা বলে লাভ আছে কিছু? যেটা অসম্ভব সেটা আমরা কেমন করে করব? তুমি কি ভাবছ আমাদের কাছে আলাদীনের প্রদীপ আছে? ইচ্ছে করব আর ওমনি হয়ে যাবে?
কতক্ষণ লাগবে তা হলে?
সেটা না দেখে বলতে পারব না। এক সপ্তাহ লাগতে পারে বেশিও লাগতে পারে।
হাকশী খানিকক্ষণ কী যেন ভাবল, তারপর বলল, ঠিক আছে, তোমাদের এক সপ্তাহ সময় দিলাম। এর ভেতর সব যদি ঠিকঠাক করে দিতে পার—আমি নিজে সবকিছু পরীক্ষা করে দেখব, তারপর তোমাদের জেসমিন ছাড়া পাবে।