হাকশী জাহিদ আর কামালের দিকে তাকিয়ে গলার স্বরে বিষ মিশিয়ে বলল, আমার দলের সর্বশ্রেষ্ঠ লোকগুলির একজনকে হত্যা করার অপরাধের শাস্তি নেয়ার জন্যে প্রস্তুত হও।
কী করতে চায় হতভাগাটা? জাহিদ মনে মনে ঘেমে উঠলেও বাইরে শীতল ভাব বজায় রেখে বলল, হাকশী, তুমি যদি সত্যি সত্যি টার্নারকে হত্যা করার জন্যে শাস্তি দিতে চাও, তা হলে শুধু আমাকেই সে শাস্তি দিতে হবে। তুমি খুব ভালো করে জান দুর্ঘটনাটা যখন ঘটেছে তখন কামাল সেখানে ছিল না।
তার মানে এই নয় পরিকল্পনাটাতে কামালের কোনো ভূমিকা ছিল না। তা ছাড়া হাকশী। কামাল হাকশীর চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি আমাদের তোমার বিরুদ্ধে যাবার সুযোগ দিয়েছিলে। বলেছিলে, দু’টি সুযোগ দেবে—তৃতীয়বার শাস্তি দেবে! তা হলে প্রথমবারেই আমাদের শাস্তি দিতে চাইছ কেন?
শুনবে, কেন প্রথমবারই তোমাদের শেষ করে দিচ্ছি?
জাহিদ বুঝতে পারল হাকশী কী বলবে—কিন্তু মুখে কৌতূহল ফুটিয়ে জিজ্ঞেস করল, কেন?
কারণ তোমরা দুজন কী-একটা আশ্চর্য উপায়ে ফ্রিপসিকে ধোঁকা দিয়েছ। ফ্রিপসি তোমাদের সম্পর্কে ভুল তথ্য দিয়েছে। তোমাদের এই ভয়ংকর পরিকল্পনা সম্পর্কে আমায় কিছুই বলে নি।
উপস্থিত সবাই ভয়ানক চমকে উঠল—সেখানে দেয়াল ফেটে একটা জীবন্ত পরী বেরিয়ে এলেও বুঝি লোকজন এত অবাক হত না। সেকেণ্ড দশেক সবাই দমবন্ধ করে থেকে একসাথে চেচামেচি শুরু করে দিল। হাকশী কঠোর স্বরে ধমকে উঠল, থাম—
সাথে সাথে হঠাৎ দপ করে সব আলো নিভে গেল। লোকজনের প্রচণ্ড কোলাহলের মাঝে জাহিদ শুনতে পেল, ঘড়িতে ঠিক সাড়ে এগারোটা বাজার ঘন্টা পড়ছে।
কেউ এক পা নড়বে না—তা হলে গুলি করে সবার বুক ঝাঝরা করে দেয়া হবে। অন্ধকারে হারুন হাকশী নিষ্ঠুরভাবে চেঁচিয়ে উঠল, সবাই মেঝেতে হাত রেখে বসে পড়–মেঝে থেকে দু’ ফুট উচু দিয়ে গুলি করা হবে। সবাই হুড়মুড় করে বসে পড়েছে, জাহিদ তার শব্দ পেল। পরমুহূর্তে একঝাঁক গুলি তাদের মাথার উপর দিয়ে দেয়ালে গিয়ে বিঁধল।
জাহিদ মুখ টিপে হাসল, হারুন হাকশী ভয় পেয়েছে। দারুণ ভয় পেয়েছে। অন্ধকারে সে হাত বাড়িয়ে কামালের হাত স্পর্শ করে চাপ দিল—কামাল সত্যি সত্যি তাহলে জ্বালানির টিউব পাল্টে দিতে পেরেছে। সাড়ে এগারোটায় নতুন জ্বালানি দিয়ে কাজ শুরু করানোর সাথে সাথে তাই সবকিছু বন্ধ হয়ে গেছে।
একটা চাপা শব্দ করে প্লুটোনিকের নিজস্ব ডায়নামো চালু হয়ে গেল খানিকক্ষণের মধ্যেই। ধীরে ধীরে মিটমিটে ভৌতিক আলো জ্বলে উঠল। আবছা আলোছায়াতে দেখা গেল, মেঝেতে শ’ চারেক লোক মাথানিচু করে গুড়ি মেরে বসে আছে, হাকশীর গোটা চারেক দেহরক্ষী তাদের দিকে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র তাক করে আছে। জাহিদ এবং কামালের দিকে অন্য দু’জন দেহরক্ষী ট্রিগারে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে। হাকশী অন্ধকারে সরে গেছে অনেক ভেতরের দিকে, নিরাপদ দূরত্বে। আলো জ্বলে ওঠার পর সে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে এগিয়ে এল। উপস্থিত লোকদের উদ্দেশ করে বলল, তোমরা একজন একজন করে বেরিয়ে নিজেদের ঘরে চলে যাও। আজ তোমাদের সবার ছুটি। মনে রাখবে, ঘরের বাইরে কাউকে পাওয়া গেলে সাথে সাথে গুলি করা হবে!
লোকগুলি ভয়ে ভয়ে উঠে দাঁড়াল, ছারপর একজন একজন করে বেরিয়ে যেতে লাগল। শেষ লোকটি বেরিয়ে যাবার পর হাকশী জাহিদ এবং কামালের দিকে এগিয়ে এল। বলল, এটাও তোমাদের কাজ, না?
জাহিদ দাঁত বের করে হাসল। হালকা স্বরে বলল, তোমার কী মনে হয়? ভূতের?
ঠাট্টা রাখ। প্রচণ্ড শব্দে হাকশী ধমকে উঠল—তোমার সাথে আমি তামাশা করছি না।
জাহিদ শীতল স্বরে বলল, দেখ হাকশী, তুমি আর চোখ রাঙিয়ে কথা বলার চেষ্টা করো না। তোমাকে আমরা আর এতটুকু ভয় পাই না। নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টর নষ্ট করে এসেছি, ওটা যদি ঠিক করতে পার—জাহিদ একটু হাসল হ্যাঁ, যদি তোমার টেকনিশিয়ানরা ঠিক করতে পারে, শুধু তাহলেই প্লুটোনিক বেঁচে যাবে। আর তা যদি পার, তা হলে সেই মুহূর্তে তোমার ঐ ধুকপুকে ডায়নামোটা শেষ হয়ে যাবে—আলো, তাপ, বাতাস, খাবার পানি সবকিছুর অভাব শুরু হয়ে যাবে। খুব বেশি হলে দশ দিন বেঁচে থাকতে পারবে
স্কাউণ্ড্রেল! তোমরা বেঁচে যাবে ভাবছ?
মোটেই না। জাহিদ উদারভাবে হাসে, অনেক দিন বেঁচেছি, আর বাঁচার শখ নেই। তোমাকে শেষ করে যদি মারা যাই, খোদা নির্ঘাত বেহেশতে আমাকে একটা প্রাসাদ। বানিয়ে দেবে। হুর পরী
চুপ কর। তোমার কথাও আমি বিশ্বাস করি না। আমি টেকনিশিয়ানদের পাঠাচ্ছি। ওরা রি-অ্যাক্টর ঠিক করবে। তারপর হাকশী দাঁত চিবিয়ে কী যেন বলার চেষ্টা করে তার আগেই কামাল হো-হো করে হেসে উঠে বলল, হাকশী, জাহিদের কথা বিশ্বাস নাই-বা করলে! আমার কথা বিশ্বাস করবে? তা হলে শোন, আমি হচ্ছি রিঅ্যাক্টর ইঞ্জিনিয়ার। আমাকে শেখানো হয় রি-অ্যাক্টর কীভাবে তৈরি করা হয়, তার কোথায় কি থাকে, রি-অ্যাক্টরের কোন অংশে কি করলে সেটার কি পরিমাণ ক্ষতি হয়, আমার চেয়ে ভালো কেউ জানে না। অবশ্যি টার্নার জানত, কিন্তু বেচারা মাথাগরম করে মারা পড়ল। কামাল চুকচুক শব্দ করে খানিকক্ষণ দুঃখ প্রকাশ করল।
তুমি কী বলতে চাও?
এখনো বোঝ নি? তা হলে শোন, জাহিদ যখন টার্নারকে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করছিল, তখন আমি কন্ট্রোলরুমে কী করছিলাম, তুমি জান?