ফ্রিপসি যখন দেখবে তার ভবিষ্যদ্বাণীকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে কামাল এরকম একটা বেআইনি কাজ করে ফেলছে, নিশ্চয়ই তখন সাইরেন বাজিয়ে সবাইকে সতর্ক করে দেবে। ডিক টার্নার যখন খবর পাবে কামাল কন্ট্রোলরুমে ঢুকে পড়েছে, তখন সে ক্ষ্যাপা কুকুরের মতো হয়ে পড়বে। বাইরে থেকে পাওয়ার বন্ধ করে দিয়ে তাকে বিপদে ফেলতে পারে, কিন্তু পরবর্তী পনের মিনিট টার্নারকে কোননা-না-কোনোভাবে আটকে রাখার দায়িত্ব জাহিদের। কামাল সেটা নিয়ে মাথা ঘামাল না—খুব তাড়াতাড়ি কাজ শুরু করে দিল। জ্বালানির ছোট ছোট টিউবগুলি পাল্টে দিতে হবে। ওগুলি স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থায় রি-অ্যাক্টরের ভেতরে চলে যাবার জন্যে ট্রের উপরে সামনে আছে— কামাল সেগুলি টেনে নামিয়ে আনল। তারপর খুব তাড়াতাড়ি কাজ শুরু করে দিল— যদিও সে জানতেও পারল না তাড়াতাড়ি করার আর কোনো দরকার ছিল না। যার ভয়ে সে এত তাড়াহুড়ো করছিল, সেই ডিক টার্নার তখন গুলি খেয়ে টেবিলের উপর উপুড় হয়ে পড়ে আছে—আর কোনো দিনও তার ওঠার ক্ষমতা হবে না।
জাহিদ ডিক টার্নারের ঘরে ঢুকে একটা কাল্পনিক সমস্যা নিয়ে আলাপ জুড়ে দেয়ার চেষ্টা করেছিল। এমনিতে লোকটা নিতান্ত পাষণ্ড হলেও পদার্থবিজ্ঞান এবং যুক্তিবিদ্যায় তার অকৃত্রিম উৎসাহ রয়েছে। সত্যি সত্যি সে জাহিদের সাথে সমস্যাদি নিয়ে আলাপ করতে থাকে। কিন্তু যেই মুহূর্তে ফ্রিপসি সাইরেন বাজিয়ে দিয়ে জানিয়ে দিল কামাল হঠাৎ করে বেআইনিভাবে জ্বালানিঘরে ঢুকে পড়েছে, তখন টার্নার লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল; কি করবে বুঝতে না পেরে চিৎকার করে জাহিদকে বলল, পাওয়ার বন্ধ কর।
জাহিদ ঠাণ্ডা গলায় বলল, কেন?
সাথে সাথে টার্নার বুঝে গেল যড়যন্ত্রে জাহিদও রয়েছে। সে নিচু হয়ে ড্রয়ার থেকে একটা ছোট রিভলবার বের করে এবং জাহিদের দিকে তাক করে ধরল। জাহিদ ভেবেছিল ভয় দেখানোর চেষ্টা করছে এবং কীভাবে আরো খানিকক্ষণ ওকে ব্যস্ত রাখা যায় মনে মনে ঠিক করে নিচ্ছিল। কিন্তু টার্নার ভয় দেখানোর ধারেকাছে গেল না, সোজাসুজি তাকে গুলি করে বসল। শেষমুহুর্তে লাফিয়ে সরে যাওয়ার জন্যেই হোক, টার্নারের অপটু হাতের ভুল নিশানার জন্যেই হোক, জাহিদের ডান হাতের খানিকটা মাংস ছিড়ে বেরিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোনো ক্ষতি হল না। জাহিদকে লক্ষ করে দ্বিতীয়বার গুলি করার চেষ্টা করার সময় জাহিদ মরিয়া হয়ে টানারের উপর লাফিয়ে পড়েছে—রিভলবার কেড়ে নিতে গিয়ে হ্যাচকা টানে ট্রিগারে চাপ পড়ে একটা গুলি ওর মাথার ভিতর দিয়ে চলে গেছে। ফলস্বরূপ টার্নার এখন শীতল দেহে টেবিলে উপুড় হয়ে পড়ে আছে—থিকথিকে রক্তে চারদিক ভেসে যাচ্ছে আর তাই দেখে জাহিদের গা গুলিয়ে উঠছে।
জাহিদ রিভলবারটা টেবিলের উপর রাখল বাইরে ভীষণ হৈচৈ চেচামেচি শুনতে পাচ্ছে। হাকশী আর তার দলবল ছুটে আসছে। হাকশীও কি টার্নারের মতো দেখামাত্র গুলি করে বসবে? নাকি ওর কথা শোনার জন্যে খানিকক্ষণ সময় নেবে? কামাল এতক্ষণে কী করল কে জানে! জাহিদ রুমাল বের করে কপালের ঘাম মুছল। দু’মিনিটের ভিতর দরজায় হাকশী এসে দাঁড়াল, পিছনে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র হাতে নাকভাঙা আমেরিকানটা।
জাহিদ সেকেণ্ড দশেক অপেক্ষা করল, না। হাকশী এখন তাকে মারবে না। তাহলে এ-যাত্রায় সে বেঁচে যেতেও পারে। খুব কষ্ট করে জাহিদ মুখে হাসি ফুটিয়ে এনে বলল, টার্নারের কাণ্ড দেখেছ! খামোকা গুলি খেয়ে মারা পড়ল! কী দরকার ছিল আমাকে গুলি করার?
হাকশী কোনো উত্তর দিল না। চোখ দুটিকে ছুরির মতো করে ওর দিকে তাকিয়ে রইল। হাকশীর বিশেষ নির্দেশে সবাই এসে জমা হয়েছে বড় হলঘরে। প্রথমবার দেখা গেল হাকশীর দেহরক্ষীরা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র হাতে হলঘরের বিভিন্ন জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। ঘরের ঠিক মাঝখানে একটা কফিন। কফিনে টার্নারের মৃতদেহ। একপাশে গম্ভীর মুখে হাকশী, অন্য পাশে জাহিদ আর কামাল দু’জনের হাতেই হাতকড়া। উপস্থিত সবাই বিশেষ বিচলিত কথাবার্তা নেই মোটেও। কৌতূহল নিয়ে অপেক্ষা করছে কী ঘটে দেখার জন্যে। জেসমিনকে ভীষণ ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে—একটা চেয়ার ধরে কোনোভাবে দাঁড়িয়ে আছে। বিস্ফারিত দৃষ্টিতে জাহিদ আর কামালকে লক্ষ করছে—দেখে মনে হয় সে যেন ওদের চিনতে পারছে না।
তোমরা সবাই শুনেছ—হাকশী অনেকটা বক্তৃতার ভঙ্গিতে কথা বলতে শুরু করল, জাহিদ আর কামাল মিলে টার্নারকে হত্যা করেছে–
মিথ্যা কথা। জাহিদ বাধা দিল, আমি কখনোই টার্নারকে হত্যা করি নি। আমাকে হত্যা করতে চেয়েছিল টার্নার ফ্রিপসিকে জিজ্ঞেস করে দেখ। বেকায়দা গুলি খেয়ে নিজেই মরেছে।
হাকশী এমন ভান করল যে, জাহিদের কথা শুনতে পায় নি। চাপা খসখসে স্বরে বলে যেতে লাগল, সে শুধু যে টার্নারের মতো প্রতিভাবান বিজ্ঞানীকে হত্যা করেছে তাই নয়–রি-অ্যাক্টরের কন্ট্রোলরুমে ঢুকেছিল বিনা অনুমতিতে তাদের এই অবাধ্যতার শাস্তি দেয়া হবে এখনই, এখানেই। এমন শাস্তি দেব যে পৃথিবীর মানুষ শুনতে পেলে আতঙ্কে শিউরে উঠবে।
জেসমিন একটা আর্তস্বর করে চেয়ারে বসে পড়ল। সবাই তাকে একনজর দেখে হাকশীর দিকে ঘুরে তাকাল।
জাহিদ আলগোছে হাত তুলে ঘড়িটা দেখল। সাড়ে এগারোটা বাজতে এখনও মিনিট কয়েক বাকি রয়েছে। হাকশীকে আরও খানিকক্ষণ আটকে রাখতে না পারলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।