সেটা কীভাবে করবি?
কামাল মাথা চুলকাল সবার সামনে দিয়ে ফ্রিপসির ইলেকট্রিসিটি বন্ধ করে। দেয়া একেবারেই অসম্ভব!
আচ্ছা। এক কাজ করা যায় না?
কি?
নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টরটা বন্ধ করে দেয়া যায় না? তাহলেই তো প্লুটোনিকের পুরো পাওয়ার বন্ধ হয়ে যাবে।
কীভাবে করবি? টার্নার ওখানে শকুনের মতো বসে থাকে।
তুই তো নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টরের ইঞ্জিনিয়ার, এখানে ঢুকে কিছু করতে পারিস না?
কামাল ভাবতে থাকে। অনেকক্ষণ পরে বলে, তুই যদি টার্নারকে খানিকক্ষণ অন্য দিকে ব্যস্ত রাখতে পারিস, তা হলে চেষ্টা করে দেখতে পারি।
কীভাবে করবি?
বলছি শোন—কামাল জাহিদকে পরিকল্পনাটা বুঝিয়ে বলতে থাকে, জাহিদ গম্ভীর হয়ে শোনে।, ঠিক সেই সময়ে হাকশী ছুটে আসছিল ওদের খোঁজে—ফ্রিপসি জরুরি বিপদসংকেত দিয়েছে।
বাথরুমের দরজা খুলে হাকশী এবং তার পিছনে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র হাতে নাকভাঙা আমেরিকানটাকে দেখে জাহিদ বুঝতে পারল, ওরা ধরা পড়ে গেছে।
হাকশী সরু চোখে ওদেরকে খানিকক্ষণ লক্ষ করল, তারপর কামালকে বলল, তোয়ালেটা ওখান থেকে সরিয়ে রাখ। ট্যাপগুলি বন্ধ কর।
কামাল তোয়ালেটা সরিয়ে নিয়ে খোলা ট্যাপগুলি বন্ধ করে দেয়—এতক্ষণ পানির ঝিরঝির শব্দে কান অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল হঠাৎ করে নীরবতা অস্বাভাবিক ঠেকল।
হাকশী গম্ভীর স্বরে জিজ্ঞেস করল, তোমরা কী নিয়ে আলাপ করছিলে?
জাহিদ ভিতরে ভিতরে চমকে উঠল, কিন্তু বাইরে খুব শান্ত ভাব বজায় রেখে বলল, তোমার ফ্রিপসিকে জিজ্ঞেস কর।
ফ্রিপসিকে জিজ্ঞেস করেই এসেছি–
তা হলে আর আমাদের জিজ্ঞেস করছ কেন?
হাকশী খানিকক্ষণ চুপ থেকে বলল, ভবিষ্যতে এরকম কাজ করবে না।
কী রকম কাজ?
টেলিভিশন ক্যামেরা আর মাইক্রোফোনকে এড়িয়ে যাওয়া।
দু’ -এক মিনিটের জন্যে গেলে ক্ষতি কি?
সে কৈফিয়ত আমি তোমাকে দেব না। ফ্রিপসির চোখের আড়াল হওয়া চলবে না। যদি আড়াল হওয়ার চেষ্টা কর, সোজাসুজি মহাকাশে ছুঁড়ে ফেলে দেব।
বেশ!
আর কার্বন-মনোক্সাইড ব্যবহার করে খুব একটা সুবিধে করতে পারবে না প্লুটোনিকে বিষাক্ত গ্যাস বিশুদ্ধ করার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা রয়েছে।
জাহিদ চমকে ওঠার ভান করল—তারপর মুখে একটা আশাভঙ্গের ছাপ ফুটিয়ে তুলল। কিন্তু ভিতরে ভিতরে সে বিজয়োল্লাসে ফেটে পড়ছিল, হাকশী ধরতে পারে নি—ফ্রিপসি ধরতে পারে নি—ফ্রিপসিকে ধোঁকা দিয়ে ওরা ওদের মাথায় করে এক ভয়ানক পরিকল্পনা বয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
হাকশী চলে যাওয়ার পর জাহিদ খুব ধীরে ধীরে কামালের দিকে তাকিয়ে আছে—যদি কিছু বুঝে ফেলে? কামাল জাহিদের চোখের দিকে তাকিয়ে অনেক কিছু বুঝে ফেলল। চোখের ভাষা বুঝে নেবার মতো ক্ষমতা ফ্রিপসির নেই, তাই ফ্রিপসি জানতেও পারল না এই দু’ জন কী সাংঘাতিক পরিকল্পনা ছকে ফেলেছে।
জাহিদ সারারাত (প্লুটোনিকে দিন-রাত নেই—সুবিধের জন্যে খানিকটা সময়কে রাত নাম দিয়ে সবাই ঘুমিয়ে নেয়) খুব দুশ্চিন্তায় কাটাল—ওর কাজকর্ম ভাবভঙ্গি যদি ফ্রিপসির ভবিষ্যদ্বাণীর সাথে মিলে না যায়, তাহলে হাকশী সন্দেহ করতে পারে। জাহিদ খুব সাবধানে কথা বলছিল—যখন ঠিক যেমনটি করা উচিত তখন ঠিক তেমনটি করে যাচ্ছিল। অন্ততপক্ষে একটি সপ্তাহ এভাবে কাটাতে হবে। সবচেয়ে মুশকিল কামালের সাথে এ বিষয়ে আর একটি কথাও বলা যাবে না। অপেক্ষা করে থাকতে হবে কবে কামালের কাছ থেকে সেই সংকেতটি আসে।
হাকশী প্রথম দু’দিন খুব অস্বস্তির সাথে দেখতে পেল জাহিদ আর কামালের কথাবার্তা ভাবভঙ্গি প্রায়ই ফ্রিপসির ভবিষ্যদ্বাণীর সাথে খাপ খাচ্ছে না। যদিও খুবই ছোটখাটো ব্যাপার, কিন্তু বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। সে সতর্ক থাকল এবং গোপন পাহারার ব্যবস্থা করল। তিন দিনের মাথায় আবার সব ঠিক হয়ে যাবার পর সে নিশ্চিন্ত হল, যদিও ব্যাপারটি দেখে তার বিস্ময়ের সীমা ছিল না।
খাবার টেবিলে কাপে চা ঢালতে গিয়ে কামালের হাত থেকে খানিকটা চা ছলকে পড়ল। জেসমিন বিরক্ত হয়ে বলল, যেটা পার না সেটা করতে যাও কেন? দেখি, আমাকে দাও।
জেসমিন চা ঢেলে দিতে থাকে। জাহিদ খুব ধীরে ধীরে কামালের চোখের দিকে তাকাল। বুঝতে পারল আজকেই ঘটবে সেই ব্যাপারটা! টেবিলে চা ফেলে দেয়া আকস্মিক ঘটনা নয়—জাহিদকে সতর্ক করে দেয়া। চা শেষ করে উঠে দাঁড়াল—যার যার কাজে যাবে।
প্লুটোনিকের সমস্ত শক্তি আসে ছ’তলায় বসানো নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টর থে ব্যাপারটার পুরো দায়িত্বে রয়েছে ডিক টার্নার। জাহিদ টানারের ঘরে নক করে ভিতরে ঢুকে পড়ল। কামাল চলে গেল রি-অ্যাক্টরের কাছে। পাঁচ-ছয়জন টেকনিশিয়ান এখানেসেখানে কাজ করছে সবাই চুপচাপমুখে পাথরের কাঠিন্য। কামাল তার নিজের জায়গা ছেড়ে আরও ভিতরে চলে গেল।
রি-অ্যাক্টরে আজ জ্বালানি প্রবেশ করানোর দিন—জ্বালানিগুলি প্লুটোনিকের ল্যাবরেটরিতেই ইউরেনিয়ামের বিভিন্ন আইসোটোপ থেকে আলাদা করা হয়। প্রচণ্ড তেজস্ক্রিয় সেসব জ্বালানি খুব সাবধানে রাখা হয়। টার্নার ছাড়া আর কেউ সেখানে হাত দিতে পারে না।
কামাল দ্রুতহাতে স্বচ্ছ একটা পোশাক পরে নিতে থাকে। তেজস্ক্রিয় আইসোটোপের কাছে যেতে হলে এই পোশাক পরে নিতে হয়। উপরে আরো এক প্রস্থ সিলেফেনের পোশাক পরে নেয়া নিয়ম কামাল সে জন্যে অপেক্ষা করল না। সে দ্রুত পায়ে কন্ট্রোলরুমে ঢুকে পড়ে। পরপর তিনটি ভারী দরজা খুলে ভিতরে ঢুকতে হয়। শেষ দরজাটি বন্ধ করে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। এতক্ষণে বাইরে নিশ্চয়ই হৈচৈ শুরু হয়ে গেছে।