আস্তে আস্তে যতই দিন পার হতে লাগল, ওরা তিনজনই বোধশক্তিহীন যন্ত্র হয়ে যেতে লাগল। জেসমিনকে সাহস দিয়ে বেড়াত কামাল—ভবিষ্যতের রঙিন স্বপ্ন দেখার চেষ্টা করত—কিন্তু আসলে তাতে খুব একটা লাভ হত না। নিজেও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আশাবাদী নয়।
একটা অক্ষম স্থবিরতা ওদের গ্রাস করে ফেলছিল ধীরে ধীরে। তার থেকে বুঝি কারো মুক্তি নেই!
জাহিদ বুঝতে পেরেছে সে হাকশীর কাছে হেরে গেছে। অনেক অহঙ্কার করে সে হাকশীকে বলেছিল তার প্লুটোনিক ধ্বংস করে দিয়ে সে প্রতিশোধ নেবে কিন্তু তার কথা সে রাখতে পারে নি। ফ্রিপসি নিখুঁতভাবে প্রতিটি চিন্তাভাবনা হাকশীকে জানিয়ে দিয়েছে। মানুষের মনের গোপন ভাবনাটিও যখন একজন প্রতিমুহূর্তে জেনে নেয়, তখন তার মতো অসহায় বুঝি আর কেউ অনুভব করে না। জাহিদ বিষণ্ণমুখে গোল জানালাটি দিয়ে মহাকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে—এইদিক দিয়ে কোটিখানেক মাইল দূরে পৃথিবী। পৃথিবীতে ফিরে যাবার প্রচণ্ড আকাঙ্খা তাকে প্রতিমুহূর্তে বেঁচে থাকার প্রেরণা দিচ্ছে—এ ছাড়া সে বোধ করি পাগল হয়ে যেত। অবসর সময়ে সে হিসেব করে দেখে। দু বছর শেষ হতে আর কত দেরি। গোল জানালা দিয়ে নিকষ কালো অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তার চোখের সামনে পৃথিবীটা ভেসে ওঠে। তার দেশে এখন অঝোর ধারায় বৃষ্টি হচ্ছে। আকাশ কালো করে মেঘ হয়ে বিজলি চমকাচ্ছে, গুরুগুরু মেঘের ডাক—
জাহিদ।
জাহিদ বাস্তবে ফিরে এল—ঘুরে দেখে, কামাল। আজকাল ওদের দেখা হয় কম, কথাবার্তা হয় আরো কম। পূটোনিকের অন্য একজন সাধারণ অধিবাসীর সাথে কামালের পার্থক্য দিনে দিনে কমে আসছিল—সে নিজেও তেমনি একজন প্লুটোনিকের যন্ত্র হয়ে উঠছিল। অনেকদিন পরে কামালকে দেখে জাহিদের হঠাৎ করে আরো বেশি মন-খারাপ হয়ে গেল। কয়দিন আগেও তারা দু’জন একসাথে এন্ড্রোমিডাতে হৈচৈ করে বেড়িয়েছে।
কি রে কামাল, কিছু বলবি?
জাহিদ—কামালের চোখ উত্তেজনায় জ্বলজ্বল করছে।
জাহিদ ভারি অবাক হল। প্লুটোনিকের এই একঘেয়ে জীবনে এমন কী ঘটনা ঘটতে পারে, যা কামালকে এত উত্তেজিত করে তুলতে পারে? কামালকে জিজ্ঞেস করল, কি হয়েছে?
কামাল কোনো কথা না বলে জাহিদের হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল বাথরুমে। ফ্রিপসির জন্যে প্লুটোনিকের সর্বত্র রয়েছে অজস্র চোখ আর কান টেলিভিশন ক্যামেরা। আর মাইক্রোফোন। কোন ঘরে কোথায় আছে সেটা কারো জানা নেই। কামাল অনেক খুঁজে বাথরুমের টেলিভিশন ক্যামেরাটি বের করেছিল, ডান পাশে আয়নার ঠিক নিচে ছোট্ট একটি গোল ফুটো, তার পিছনেই রয়েছে টেলিভিশন ক্যামেরা। কামাল একটা ভোয়ালে দিয়ে সেটা ঢেকে দিল। তারপর ট্যাপ আর শাওয়ার খুলে পানির শব্দ দিয়ে মাইক্রোফোনটিকে অচল করে দিয়ে জাহিদের দিকে ঘুরে দাঁড়াল।
জাহিদ এতক্ষণ কামালের প্রস্তুতি দেখে ভারি অবাক হয়। কামাল এমন কী কথাটি বলবে যেটি ফ্রিপসিকে জানতে দিতে রাজি নয়? ফ্রিপসি জানে না এমন কিছুই যখন তাদের জানা নেই। কামালকে জিজ্ঞেস করল, কি বলবি?
কামাল খুব নিচু গলায় বলল, আমি জেসমিনকে ভালবাসি, তুই জানিস?
শুনে জাহিদ ভারি অবাক হল—এটি এমন কোনো বিচিত্র ব্যাপার নয়। সে নিজে প্রেম-ভালবাসার ব্যাপারে মোটেই স্পর্শকাতর নয়, কিন্তু কামালের জন্যে এটি খুবই স্বাভাবিক বিশেষ করে যখন পরিস্থিতি হঠাৎ করে তাদের এরকম অবস্থায় এনে ফেলেছে। জাহিদ অবাক হল এই ভেবে যে, এ কথাটি বলার জন্যে এত সতর্কতা কেন? সে কামালের দিকে তাকিয়ে বলল, তাতে কী হয়েছে?
কামাল কাঁপা গলায় বলল, ফ্রিপসি জানে না।
জাহিদ ভীষণ চমকে উঠল—চেচিয়ে উঠে জিজ্ঞেস করল, কী বললি!
আস্তে। ফ্রিপসি শুনতে পাবে! আজ দুপুরে হাকশীর ঘরে গিয়েছিলাম ভেন্টিলেশান টিউব পরীক্ষা করতে। হাকশীর সাথে গল্প করে আমার সম্পর্কে ফ্রিপসির আজকের রিপোর্টটা দেখতে চাইলাম, এমনি ইচ্ছে হচ্ছিল দেখতে। কি কারণে জানি ব্যাটার মন ভালো ছিল, দেখতে দিল। আমার সম্পর্কে ভুল ভবিষ্যদ্বাণী করেছে। পাঁচটার সময় জেসমিনকে নিয়ে ছ’তলায় গিয়ে নিরিবিলি গল্প করব ঠিক করে রেখেছিলাম—অথচ ফ্রিপসি লিখেছে—পাঁচটার সময় তোর সাথে আলাপ করব। কীভাবে কার্বন মনোক্সাইড ব্যবহার করে হাকশীকে খুন করা যায়–
তুই ঠিক দেখেছিস?
হ্যাঁ তাই জেসমিনের সাথে দেখা না করে পাঁচটা বাজতেই তোর কাছে চলে এসেছি।
ফ্রিপসির তাহলে প্রেম-ভালবাসা সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই। উত্তেজনায় জাহিদের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে উঠল, ফিসফিস করে বলল, আমাদের আগেই এটা বোঝা উচিত ছিল—ফ্রিপসি তো যন্ত্র। প্রেম-ভালবাসা বুঝবে না। কেউ প্রেমে পড়লেই তার সম্পর্কে ভুল খবর দেবে।
হ্যাঁ কামালের চোখ জ্বলজ্বল করতে থাকে। এই সুযোগ ফ্রিপসি ভাবছে তোর সাথে কার্বন-মনোক্সাইড নিয়ে আলাপ করছি। এই ফাঁকে একটা সত্যিকার পরিকল্পনা করে ফেল।
এত তাড়াতাড়ি। ভাবতে হবে না? সময় দরকার—
আর কখনো সময় নাও পেতে পারিস।
জাহিদ চুল খামচে ধরে বলল, যে-পরিকল্পনাই করিস না কেন, সবচেয়ে প্রথম ফ্রিপসিকে বিকল করতে হবে—এ ছাড়া কিছু করা যাবে না।
সম্ভব না—ফ্রিপসিকে নষ্ট করা যাবে না। ভীষণ কড়া পাহারায় থাকে।
নষ্ট না করে—ওটাকে বিকল করা যায় না?
কামাল দু’-এক মুহূর্ত ভাবল, বলল, যায়।
কীভাবে?
ইলেকট্রিসিটি যদি বন্ধ করে দেয়া যায়।