জেসমিন জাহিদের কথায় ভরসা পায় না—ও বুঝতে পেরেছে হাকশীর বিরুদ্ধে যাওয়া অসম্ভব। হাকশী ইচ্ছে করলেই শুধুমাত্র এখান থেকে বের হওয়া যেতে পারে। কাজেই হাকশীকে না চটিয়ে সে সময়টুকু জেনে নিতে চাচ্ছিল। আবার জিজ্ঞেস করল আমাদের কতদিন থাকতে হবে বললে না।
হাকশী ধূর্তমুখে হেসে বলল, বেশ, তোমরাও তা হলে দু বছর পর মুক্তি পাবে।
দু-ব-ছ-র।
হাকশী চলে গেলে জেসমিন আঙুলে গুনে গুনে দেখতে থাকে দু’ বছর মানে কতদিন। কিছুক্ষণেই সে হতাশ হয়ে পড়ে।
৫. প্লুটোনিকের জীবনযাত্রা ভারি বিচিত্র
প্লুটোনিকের জীবনযাত্রা ভারি বিচিত্র। যাদেরকে পৃথিবীর নানা জায়গা থেকে ধরে আনা হয়েছে, তারা প্রথম কয়দিন খুব ছটফট করে, বিদ্রোহ-বিক্ষোভ করতে চায়, হৈচৈ চেঁচামেচি করে। কিন্তু ফ্রিপসির অদৃশ্য চোখ-কান আর অলৌকিক ক্ষমতার সামনে কয়দিনেই সবাই শিশুর মতো অসহায় হয়ে পড়ে। কয়দিন পরেই তাদের সবরকম বিদ্রোহ-বিক্ষোভের ঝোঁক কেটে যায় তখন জেলখানায় আটক বন্দিদের মতো মাথা গুজে কাজ করে যায় আর দিন গুনতে থাকে কবে বন্দিজীবন শেষ করে এখান থেকে বেরিয়ে যাবে।
হাকশী বাইরে কোথায় কি করছে না-করছে সে সম্পর্কে প্লুটোনিকের কাউকেই একটি কথাও বলে না। প্লুটোনিকের লোকজন যখন জাহিদ আর কামালের মুখে শুনতে পেল মহাকাশের সব মহাকাশযান হাকশী ধ্বংস করে ফেলেছে, তখন তাদের বিস্ময়, হতাশা আর আক্রোশের সীমা থাকল না। কিন্তু কিছু করার নেই-বুকের আক্রোশ বুকে চেপে রেখে সবাই নিজের কাজ নিজে করে যেতে লাগল। এই নরকযন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাবার একটিমাত্র উপায় হচ্ছে আত্মহত্যা করা—কিন্তু আত্মহত্যা করতে পারে। কয়জন
হাকশী কি জন্যে মহাকাশযান, কৃত্রিম গ্রহ, উপগ্রহ ধ্বংস করে বেড়াচ্ছে সেটার ােনো সদুত্তর জাহিদ খুঁজে পায় না। প্লুটোনিকের অনেকে হয়তো হাকশীর কাছে তার উদ্দেশ্য সম্পর্কে শুনেছে, কিন্তু ফ্রিপসির ভয়ে কেউ তাদের কিছু জানাল না। সুযোগ পেয়ে একদিন সে নিজেই হাকশীকে জিজ্ঞেস করল তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কি। হাকশী ওকে যা বোঝাল, সেটি যেরকম আজগুবি, ঠিক ততটুকু সঙ্গতিহীন।
সে নাকি পৃথিবীতে শান্তি ফিরিয়ে আনার একটা মহান পরিকল্পনা নিয়েছে। বিভিন্ন দেশ নিজেদের মাঝে যুদ্ধ-বিগ্রহ করে বেড়ায়—কিন্তু সব দেশ মিলে যদি একটিমাত্র রাষ্ট্রে পরিণত হয় তাহলে যুদ্ধ-বিগ্রহ করার উপায় থাকবে না। কোনো দেশ তো আর নিজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে পারে না! পৃথিবীর সব দেশ একত্র হওয়া নাকি তখনই সম্ভব, যখন একটি মহাশক্তি তাদের পরিচালনা করবে। হারুন হাকশী হবে সেই মহাশক্তি—মহাকাশ পুরোপুরি দখল করে নেয়ার পর সে সমস্ত পৃথিবীর কর্তৃত্ব পেয়ে যাবে যখন খুশি যে-কোনো দেশে পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটাতে পারবে। পৃথিবী তখন বাধ্য হবে তার কথা শুনতে।
সব শুনে জাহিদ বুঝতে পেরেছে, হাকশী হচ্ছে একটি উন্মাদ। কিন্তু এই উন্মাদের যে ক্ষমতা রয়েছে এবং সেটাকে কাজে লাগানোর যে প্রতিভা রয়েছে সেটা সত্যিই ভয়ংকর!
প্রথম কয়দিন ছটফট করে জাহিদ আর কামাল কাজে মন দিয়েছে। দু’ জনেই কাজ করে ডিক টার্নার নামে একজন বৃদ্ধ বিজ্ঞানীর অধীনে। লোকটা একটা ছোটখাট পাষণ্ড। সুযোগ পেলে সে হাকশীর পিঠেও ছোরা বসাতে পারে—কিন্তু হাকশীর নিজের অল্প কয়জন লোকজনের মাঝে ডিক টার্নার হচ্ছে অন্যতম। ডিক টানার নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টরের বিশেষজ্ঞ। নিজে নূতন ধরনের রি-অ্যাক্টর ডিজাইন করেছে, সেটি আপাতত ফোবেসে কাজ করছে।
জাহিদের কাজ ছিল জ্বালানি তৈরি করার জন্যে ইউরেনিয়ামের আইসোটোপ আলাদা করা। একঘেয়ে রুটিনবধা কাজ। কাজ করতে করতে জাহিদ হাঁপিয়ে ওঠে, কিন্তু এছাড়া আর কিছু করার নেই। নিজের কাজ সে মন দিয়ে করে আনন্দ পাওয়ার চেষ্টা করে, আর সব সময়ে সুযোগের অপেক্ষায় থাকে নির্দিষ্ট ভরের ইউরেনিয়াম ২৩৫ আলাদা করে ‘ক্রিটিক্যাল মাস’৬ করে ফেলতে পারে কি না। পারমাণবিক বোমার জন্যে ‘ক্রিটিক্যাল মাস কত সেটি তার জানা রয়েছে—কিন্তু সে পরিমাণ ইউরেনিয়ামের আইসোটোপ সে কখনও হাতে পায় না। হাকশীর সাথে দেখা হলেই হাকশী হাসিমুখে জিজ্ঞেস করে, কি হে পদার্থবিদ, অ্যাটম বোমা তৈরির কতদূর।
ফ্রিপসির দৌলতে জাহিদ পরিকল্পনা করার আগেই হাকশী সেটা জেনে গেছে।
কামালের কাজ ছিল রি-অ্যাক্টরের কাছাকাছি। অতিকায় রি-অ্যাক্টরের খুটিনাটি অনেক কিছু তাকে লক্ষ করতে হত। কাজে ফাঁকি দেয়ার উপায় ছিল না—ফ্রিপসি সব সময় নজর রাখত। রি-অ্যাক্টরকে বিল করে দেবার অনেকগুলি পথ কামাল ভেবে বের করেছে। হাকশী সেগুলি সবকয়টাই জানত। অবসর পেলে হাকশী কামালের সাথে, সেগুলি নিয়ে ঠাট্টা-তামাশা করত। কারণ হাকশী খুব ভালো করেই জানত, কামাল কোনো দিনও ফ্লিপসির চোখকে ফাঁকি দিয়ে সেগুলি কাজে লাগাতে পারবে না।”
জেসমিনের অবস্থা ছিল সবচেয়ে শোচনীয়। একটা নূতন ধরনের ভাইরাস নিয়ে তার গবেষণা করতে হচ্ছে। কি রকম অবস্থায় ভাইরাসগুলি কি ধরনের ব্যবহার করে তার একটি দীর্ঘ চার্ট করে তার সময় কাটে। এই ভাইরাসটি মানুষের মস্তিষ্কে আক্রমণ করে মানুষকে বোধশক্তিহীন করে ফেলে। হাকশী কোথায় এটি ব্যবহার করবে ভেবে জেসমিনের দুশ্চিন্তার সীমা থাকে না। জেসমিন কয়দিন হল আত্মহত্যা করার কথা ভাবছে। হাকশী ফ্রিপসির কাছ থেকে সে খবর পেয়েছে অনেকদিন আগে। তবে এ নিয়ে তার কোনো মাথাব্যথা নেই। জেসমিন যদি সত্যি সত্যি আত্মহত্যা করে তা হলে ভালোই হয়—ওকে বাচিয়ে রাখার আসলে কোনো প্রয়োজন নেই। কামাল আর জাহিদের চাপে পড়ে ওকে বাচিয়ে রাখতে হয়েছে।