ফাজলেমি করবি না। বাঁশ দিয়ে মাথায় একটা বসিয়ে দেব।
ঠিক আছে ফাজলেমি করব না।
দ্যাখ কীভাবে আমাদের দিকে তাকাচ্ছে–যেন আমাদের কথা বুঝতে পারছে।
বুঝতে পারছে না। বেজি হচ্ছে বেজি। তাদের মানুষের কথা বোঝার কথা নয়।
তাহলে পালিয়ে যাচ্ছে না কেন?
কৌতূহলে।
এত কৌতূহল কেন?
জয়ন্ত মাথা নেড়ে হাল ছেড়ে দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল, তুই কি বলতে চাইছিস এই বেজিটা দেখে আমাদের ভয়ে চিৎকার করতে করতে পালিয়ে যাওয়া উচিত?
না, তা বলছি না। শ্রাবণী ইতস্তত করে বলল, কিন্তু এটার ভাবভঙ্গি দেখে ভালো লাগছে না। হয়তো এটা পাগল–হয়তো এটা র্যাবিড।
ঠিক আছে আমি এটাকে তাড়িয়ে দিচ্ছি– বলে জয়ন্ত তার কিরিচ উঠিয়ে বেজিটার দিকে ছুটে গেল। বেজিটা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অপেক্ষা করল এবং একেবারে শেষ মুহূর্তে পেছনের দুই পায়ের ওপর ভর দিয়ে প্রায় মানুষের মতো দাঁড়িয়ে পেছন দিকে লাফিয়ে একটা ঝোঁপের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল। জয়ন্ত স্বীকার না করে পারল না, বেজিটা একটু অস্বাভাবিক। এই ধরনের বুনো প্রাণী মানুষকে আরো অনেক বেশি ভয় পায়।
জয়ন্ত শ্রাবন্তীর কাছে এসে বলল, হয়েছে তো? তোর বেজি পালিয়েছে।
শ্রাবন্তী মাথা নাড়ল, কিন্তু কোনো কথা বলল না।
তিনজন আবার হাঁটতে থাকে। হাঁটতে হাঁটতে নিয়াজ চাপা গলায় বলল, আমার ব্যাপারটা ভালো লাগছে না।
জয়ন্ত জিজ্ঞেস করল, কোন ব্যাপারটা?
নিয়াজ বলতে পারল না। প্রকৃত ব্যাপারটি যদি তারা জানত তাহলে তাদের কারোই ভালো লাগত না। তারা তখনো বুঝতে পারছিল না প্রতি পদক্ষেপেই তারা একটা বিশাল বিপর্যয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল।
.
আরো মিনিট দশেক হাঁটার পর হঠাৎ করে গাছপালা হালকা হয়ে তারা ভোলা একটা জায়গায় চলে এল। ঘন অরণ্য থেকে বের হওয়ার কারণেই তাদের ভেতরের চাপা আতঙ্কের ভাবটা একটু কমে এসেছে। তারা চারদিকে ঘুরে তাকাল এবং আবিষ্কার করল প্রায় এক কিলোমিটার দূরে একটা বাসা। এরকম একটি দ্বীপের জন্যে বাসাটি নিঃসন্দেহে আধুনিক। কিন্তু এতদূর থেকেও তাদের বুঝতে কোনো অসুবিধে হয় না যে বাসাটি দীর্ঘদিন থেকে অব্যবহৃত হয়ে পড়ে আছে। ঝোঁপঝাড়ে ঢেকে আছে জানালা খোলা, দরজা ভাঙা এবং রঙ উঠে বিবর্ণ হয়ে আছে। নিয়াজ বলল, ওটা নিশ্চয়ই পাগলা ডাক্তারের বাসা।
হ্যাঁ। শ্রাবণী মাথা নাড়ল, ভদ্রলোক নিশ্চয়ই খুব শৌখিন ছিলেন। এরকম একটা নির্জন দ্বীপে কী চমৎকার একটা বাসা তৈরি করেছেন দেখেছিস?
শৌখিন এবং মালদার। জয়ন্ত সলল, এরকম একটা নির্জন দ্বীপে এরকম একটা বাসা তৈরি করতে অনেক মালপানি দরকার।
শ্রাবণী কোনো কথা না বলে দূরে বাসাটির দিকে তাকিয়ে রইল। খানিকক্ষণ পর বলল, এতদূর যখন এসেছি তখন বাসাটি দেখে যাই।
নিয়াজ ইতস্তত করে বলল, এখনো আরো এতদূর যাবি?
এতদূর কী বলছিস? ঐ তো দেখা যাচ্ছে।
নিয়াজ একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, চল তাহলে, দেরি করিস না।
তিনজনের ছোট দলটা আবার রওনা দিল। একটু আগে সবাই মিলে যেভাবে সাবধানে হাটছিল, খোলামেলা জায়গায় এসে সেই সাবধানতাটুকু অনেক কমে গেল। তাড়াতাড়ি গিয়ে ফিরে আসার জন্যে এবারে নিয়াজ হাঁটছে সামনে–নিয়াজের পিছনে জয়ন্ত এবং সবার পিছনে শ্রাবণী।
হাঁটতে হাঁটতে নিয়াজ সম্ভবত একটু অন্যমনস্ক হয়েছিল, বাংলোর মতো চমৎকার বাসাটির কাছাকাছি চলে এসেছে সেটাও দেখছিল একটু পরে পরে, তাই ঠিক কোথায় পা ফেলছে খেয়াল করে নি। হঠাৎ করে নিয়াজ আবিষ্কার করল, সামনের ঝোঁপঝাড় লতাপাতার আড়ালে মাটি নেই এবং সে একটা গর্তে পড়ে যাচ্ছে। নিজেকে বাচানোর সহজাত প্রবৃত্তিতে সে হাতের কাছে ঝোঁপঝাড় গাছপালা যেটাই পেল সেটাই ধরার চেষ্টা করল। কিন্তু কোনোটাই তার ওজনকে ধরে রাখার মতো শক্ত নয় এবং সে সবকিছু নিয়ে পড়ে যাচ্ছিল। ঠিক তখন জয়ন্ত আর শ্রাবণী ছুটে এসে তাকে ধরে ফেলল। নিয়াজ আতঙ্কে চিৎকার করে হাত–পা ছুঁড়তে থাকে এবং আরেকটু হলে সে অন্যদেরকে টেনে নিয়ে গর্তে পড়ে যেত– কিন্তু শেষ মুহূর্তে তারা নিজেদের সামলে নিল। শ্রাবণী আর জয়ন্ত কোনোমতে নিয়াজকে গর্ত থেকে টেনে তুলল।
ঘটনার আকস্মিকতায় এত হতবাক হয়ে গেছে যে নিয়াজ প্রথমে কোনো কথা বলতে পারল না। খানিকক্ষণ চেষ্টা করে বলল, বুবি ট্র্যাপ।
বুবি ট্র্যাপ? জয়ন্ত ভুরু কুঁচকে বলল, এই জঙ্গলে বুবি ট্র্যাপ কে বসাবে?
শ্রাবণী সাবধানে গর্তটার কাছে এগিয়ে গেল। বেশ বড় গোলাকার একটা গভীর গর্ত। গর্তের ওপর লতাপাতা গাছপালা দিয়ে ঢাকা। উপর থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই যে এখানে এতবড় একটা গর্ত। শ্রাবণী মাথা নেড়ে বলল, নিয়াজ ঠিকই বলেছে। আসলেই বুবি ট্র্যাপ।
এখানে বুবি ট্র্যাপ কে বসাবে? জয়ন্ত সাবধানে পুরো জায়গাটা দেখে বলল, এই দ্বীপে কোনো মানুষ থাকে না।
হয়তো থাকে।
যদি থাকে তাহলে সে বুবি ট্র্যাপ বানাবে কেন? জয়ন্ত গর্তের উপর লতাপাতা গাছপালাগুলো দেখে বলল, আমার মনে হয় এটা একটা ন্যাচারাল ফেনোমেনন। এমনিতেই একটা বড় গর্তের উপর কিছু ঝোঁপঝাড় গজিয়েছে।
কোনো কারণ ছাড়াই?
কারণ থাকলেও সেটা প্রাকৃতিক কারণ।
জয়ন্তের ব্যাখ্যাটা কারোরই ঠিক বিশ্বাস হচ্ছিল না–কিন্তু আপাতত সেটা গ্রহণ করা ছাড়া কোনো উপায় নেই। শ্রাবণী খানিকক্ষণ গর্তটা পরীক্ষা করে নিয়াজকে জিজ্ঞেস করল, তুই ব্যথা পাস নি তো?