পরের দিন ঘুম থেকে উঠে জয়ন্ত আবিষ্কার করল, আজকের দিনটিতে তাদের ছুটি দেওয়া হয়েছে। ঢাকা থেকে বেশকিছু ভলান্টিয়ার এসেছে, তাদেরকে ব্যস্ত রাখার জন্য সব কাজকর্মই তাদের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। যেখানে বার্জটি নোর করে রাখা হয়েছে সেই দ্বীপটি ঘুরে দেখা যেতে পারে, কিন্তু এটি একেবারেই সাদামাটা একটা দ্বীপ। সাইক্লোনে ঘরবাড়ি ধুয়ে মুছে গিয়ে আরো সাদামাটা হয়ে গেছে। গ্রাম্য পথ ধরে হেঁটে আবিষ্কার করল সঙ্গে শ্রাবণী থাকার কারণে পেছনে ছোট ছোট বাচ্চার একটি বড় মিছিল তৈরি হয়ে গেছে। বাচ্চাগুলোর সাথে কথা বলার চেষ্টা করে লাভ হল না। শহরের এই মানুষগুলোকে তারা বুঝতে পারে না। কথাবার্তা বললে তারা দৌড়ে নিরাপদ দূরত্বে গিয়ে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে। এরকম সময়ে জয়ন্ত বলল, চল, হকুনদিয়া দ্বীপ থেকে ঘুরে আসি।
নিয়াজ ভুরু কুঁচকে বলল, কী বললি?
বলেছি হকুনদিয়া দ্বীপ থেকে ঘুরে আসি।
কীভাবে যাবি?
খোঁজ করলেই একটা স্পিডবোট বা ট্রলার কিছু-একটা পেয়ে যাব।
শ্রাবণী বলল, তারপর যখন খুন হয়ে যাবি তখন কী হবে?
জয়ন্ত বলল, তুই সত্যিই বিশ্বাস করিস ওখানে গেলেই মানুষ খুন হয়ে যায়?
সবাই যখন বলছে তখন নিশ্চয়ই একটা কারণ আছে।
জয়ন্ত একটু রেগে বলল, এখানকার মানুষেরা আরো কী বলেছে শুনিস নি?
কী বলেছে?
বলেছে সাইক্লোনটা সোজা আসছিল, এখানকার এক পীর সাহেব ধমক দিয়ে পুবদিকে সরিয়ে নিয়েছেন। বলছে গভীর রাতে গ্রামের রাস্তায় রাস্তায় ওলাবিবি ইনিয়ে বিনিয়ে কাঁদছে–যার অর্থ গ্রামের সব মানুষ কলেরায় মরে যাবে। বলছে চাঁদনী রাতে সুপারি গাছে বসে বসে পরীরা আকাশে উড়ছে। আরো শুনবি?
থাক, অনেক বক্তৃতা হয়েছে।
জয়ন্ত গলা উঁচিয়ে বলল, তোরা যেতে না চাইলে নাই। দরকার হলে আমি একা যাব।
কেন?
প্রমাণ করতে চাই পুরোটা কুসংস্কার। আর কিছু না হোক তখন মানুষ আবার এই সুন্দর দ্বীপটায় থাকতে পারবে।
শ্রাবণী কিছু না বলে জয়ন্তর চোখে তাকিয়ে রইল। জয়ন্ত বলল, মনে করিস না আমি পাগলামো করছি। এরকম একটা ব্যাপার জেনেনেও যদি দ্বীপটাতে অন্তত পা না ফেলে আসি তাহলে নিজের কাছে নিজের খারাপ লাগবে, মনে হবে কুসংস্কারকে প্রশ্রয় দিয়ে ফেললাম।
ঠিক আছে। শ্রাবণী মাথা নেড়ে বলল, আমি যাব।
নিয়াজ বলল, তাহলে আমি একা আর বসে থেকে কী করব? আমিও যাব।
জয়ন্ত হাতে কিল দিয়ে বলল, চমৎকার! আমি গিয়ে দেখি একটা স্পিডবোট ট্রলার নৌকা কিছু–একটা পাই কিনা।
শ্রাবণী মনে মনে আশা করছিল রিলিফ–কাজে সবাই ব্যস্ত থাকবে, জয়ন্তের এরকম পাগলামোর জন্য কিছু খুঁজে পাওয়া যাবে না। কিন্তু দেখা গেল কিছুক্ষণের মাঝেই জয়ন্ত একগাল হাসি নিয়ে ফিরে এল, সে জব্বার মিয়াকেই পেয়ে গেছে। আবার মিয়া চাইছে না। তারা সেখানে যাক, কিন্তু যখন জোরাজুরি করেছে তখন শেষ পর্যন্ত পৌঁছে দিতে রাজি হয়েছে।
কিছুক্ষণের মাঝেই দেখা গেল, সমুদ্রের নীল পানি কেটে জব্বার মিয়ার ট্রলারটা ছুটে যাচ্ছে। ট্রলারের ছাদের ওপর তিনজন চুপচাপ বসে আছে।
.
হকুনদিয়া দ্বীপে পৌঁছে ট্রলারটাকে টেনে খানিকটা বালুর ওপর তুলে জব্বার মিয়া নেমে এল, সে এমনিতেই কথা বেশি বলে না। এখন আরো কম কথা বলছে। জয়ন্ত বলল, থ্যাংক ইউ ভেরি মাচ জব্বার মিয়া। আপনি নামিয়ে না দিলে আমাদের এখানে আসা হত না।
কাজটা ভালো হল না। জব্বার মিয়া নিচুগলায় বলল, এর আগেরবার যে খুন হয়েছে, আপনাদের মতোই একজন ছিল। কিছু–একটা সাহস দেখানোর জন্যে এসেছিল, এসে খুন হল।
জয়ন্ত একটু ফ্যাকাসে মুখে বলল, আমরা খুন হব না। আপনি কোনো চিন্তা করবেন না।
এখানে আসতে চেয়েছিলেন, এসেছেন। জব্বার মিয়া শক্তমুখে বলল, আমি এখানে অপেক্ষা করি, আপনারা একটু ঘোরাঘুরি করে আসেন, ফেরত নিয়ে যাই।
নিয়াজ মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ জব্বার ভাই ঠিকই বলেছে। তুই আসতে চেয়েছিলি, এসেছিস। এখন চল যাই।
জয়ন্ত বলল, তোরা যেতে চাইলে যা। আমি না–দেখে যাব না।
এখানে দেখার কী আছে? জঙ্গল গাছপালা দেখিস নি কখনো?
জয়ন্ত বলল, আমি ভেতরে ঢুকে দেখতে চাই।
জব্বার মিয়া একটা নিশ্বাস ফেলে ট্রলারের পাটাতন থেকে একটা কাঠ সরাল। দেখা গেল সেখানে হাতে-তৈরি একটা বন্দুক। বন্দুকটা হাতে নিয়ে বলল, তাহলে এইটা সাথে রাখেন।
জয়ন্ত ভুরু কুঁচকে বলল, বেআইনি অস্ত্র? লাইসেন্স আছে?
লাইসেন্স কোথায় থাকবে! হাতে–তৈরি বন্দুক, ট্রলারে রাখি। চোর-ডাকাতের উৎপাতের জন্য রাখতে হয়।
না। জয়ন্ত মাথা নাড়ল, বেআইনি অস্ত্র রাখব না।
জব্বার মিয়া খানিকক্ষণ জয়ন্তের চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে একটা নিশ্বাস ফেলে বন্দুকটা আবার পাটাতনের ভেতরে রেখে কাঠ দিয়ে ঢেকে দিল। জয়ন্ত বলল, আপনি কোনো চিন্তা করবেন না জব্বার মিয়া। আমাদের কিছু হবে না। আমরা বেশি ভেতরে যাব একটু ঘোরাঘুরি করে চলে আসব।
আমায় গিয়ে রিলিফ নিয়ে যেতে হবে। রিলিফ পৌঁছে দিয়েই আমি চলে আসব। আপনারা ঠিক এইখানে থাকবেন।
ঠিক আছে।
অন্ধকার হয়ে গেলে কিছুতেই দ্বীপের ভেতরে থাকবেন না। আমি অন্ধকার হওয়ার আগেই আসব।
ঠিক আছে।
জব্বার মিয়া এবার ট্রলারের ছাদের সাথে লাগানো একটা লম্বা কিরিচ টেনে বের করে ওদের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, এইটা সাথে রাখেন। এইটা রাখার জন্য লাইসেন্স লাগে না।