ভদ্রলোকের চোখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, আসল সফদর আলীর ভুঁড়ি আছে? মাথায় টাক?
ভদ্রলোককে নিরাশ করতে আমার একটু খারাপই লাগে, কিন্তু কী করব, বলতেই হয় সফদর আলীর ভুঁড়ি নেই, টাক নেই—বেমানান গোঁফ আছে, কিন্তু সেটা তো আর নাম শুনে চোখের সামনে ভেসে ওঠে নি।
মানুষের নাম এবং চেহারার মধ্যে সামঞ্জস্য নিয়ে খানিকক্ষণ কথাবার্তা হল। সুযোগ পেয়ে একসময় আমি বানরের কথাটা তুলে আনি। আমি খোলাখুলিভাবে বললাম বানরটার কেন প্রয়োজন, সফদর আলী তাকে কাজকর্ম শিখিয়ে সহকারী বানাবেন। আমি ভদ্রলোককে সফদর আলী সম্পর্কে বললাম, তিনি একজন শখের বিজ্ঞানী এবং লোকজনের ধারণা, তাঁর মাথায় ছিট আছে, আমার নিজেরও সে সম্পর্কে কোনো সন্দেহ নেই, কিন্তু তিনি নেহায়েতই এক জন ভালোমানুষ। বানরটিকে তিনি নানারকম জিনিস শেখাবেন, কিন্তু কখনোই তিনি কোনোরকম কষ্ট দেবেন না। আমার ধারণা তিনি কষ্ট দেয়ার ব্যাপারটি ভালো বোঝেন না।
ভদ্রলোক এককথায় বানরটি দিয়ে দিতে রাজি হয়ে গেলেন, আমি একটু কায়দা করে টাকার প্রসঙ্গটা তুলতেই ভদ্রলোক হা হা করে উঠলেন, বললেন, জংবাহাদুর আমার ছেলের মতো, আমি তাকে বিক্রি করতে পারি?
জংবাহাদুর?
হ্যাঁ, জংবাহাদুর আমার বানরটার নাম। কেউ তাকে যত্ন করে রাখলে এমনিই দিয়ে দেব, কিন্তু বিক্রি আমি করতে পারব না। মাঝেমধ্যে গিয়ে দেখে আসব, কিন্তু টাকা আমি কী ভাবে নিই?
এবারে আমি উল্টো লজ্জা পেয়ে যাই। একটু থতমত খেয়ে বললাম, আপনার এত শখের বানর দিয়ে দিচ্ছেন কেন, রেখে দিন।
ভদ্রলোক খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে গলা নামিয়ে বললেন, আপনাকে তাহলে বলি, আগে কাউকে বলি নি। আমার একটা ছেলে আছে, এক বছর বয়স, জংবাহাদুরকে তার ভারি পছন্দ। আমি বাবা, আমার কাছে আসতে চায় না, দিনরাত্রি জংবাহাদুরের পিছনে ঘুরঘুর করে। যত দিন যাচ্ছে ততই আমার থেকে দূরে সরে যাচ্ছে, বাবা হয়ে আমি সেটা কেমন করে সহজভাবে নিই? বুঝতেই পারেন জংবাহাদুর যেরকম খেলা দেখাতে পারে, আমি কি আর সেরকম খেলা দেখাতে পারি? ছেলের কী দোষ? সে আমাকে পছন্দ করবে কেন? এক বছরের ছেলে কি আর এত কিছু বোঝে?
আমাকে স্বীকার করতেই হল বানরের সাথে খেলা দেখানো নিয়ে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা খুব সহজ ব্যাপার নয়। ভদ্রলোকের সাথে আরো খানিকক্ষণ গল্পগুজব হল, বেশ মানুষটি। আরো এককাপ সর-ভাসা চা খেয়ে উঠে পড়ার আগে বললাম, বানরটা করে নিতে আসব?
ভদ্রলোক এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বললেন, এখনই নিয়ে যান।
এখনই? আমি?
হ্যাঁ, জংবাহাদুর খুবই ভদ্র, বিরক্ত করবে না। বয়স হয়েছে, বানরের হিসেবে রীতিমতো বুড়ো, খুব শান্ত। নিজের চোখেই দেখেন, বলে ভদ্রলোক চিৎকার করে ডাকলেন, জংবাহাদুর, এদিকে এস।
পর্দার ফাঁক দিয়ে একটা বানরের গম্ভীর মুখ দেখা গেল, আমাকে খানিকক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে বানরটি আবার পর্দার আড়ালে অদৃশ্য হয়ে যায়। আমি ভদ্রলোকের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই তিনি আমাকে আশ্বস্ত করে বললেন, আপনাকে নতুন দেখেছে তো তাই কাপড় পাল্টে আসছে।
সত্যি তাই, একটু পরেই একটা লুঙ্গি পরতে-পরতে বানরটা বেরিয়ে এল, হেঁটে হেঁটে আমার সামনে এসে হাত তুলে আমাকে একটা সালাম করে গম্ভীর হয়ে একটা চেয়ারে বসে। আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না আমার কি সালামের উত্তর দেয়ার প্রয়োজন। আছে কি না।
ভদ্রলোক বানরটিকে বললেন, সংবাহাদুর, তুমি, এখন এই ভদ্রলোকের সাথে যাবে, বুঝতে পেরেছ? বানরটি কী বুঝল জানি না, কিন্তু গম্ভীরভাবে মাথা নাড়ল, যেন সত্যি বুঝতে পেরেছে। ভদ্রলোক আবার বললেন, যাও, শার্ট পরে এস, আর তোমার দড়িটি নিয়ে এস।
বানরটি সত্যিই ভদ্রলোকের কথা শুনে চেয়ার থেকে নেমে ভেতরে চলে গেল।
ভদ্রলোক একটা নিঃশ্বাস ফেলে চুপ করে গেলেন, হঠাৎ আমার তার জন্যে খুব কষ্ট হল, খুব শখের বানর, নিজেই বলেছেন একেবারে নাকি ছেলের মতো, দিয়ে দিতে নিশ্চয়ই তাঁর খুব খারাপ লাগছে। আমি আস্তে আস্তে বললাম, দেখেন, আপনার যদি খুব খারাপ লাগে, থাকুক, আমরা অন্য একটা বানর জোগাড় করে নেব।
ভদ্রলোক বললেন, খারাপ তো লাগছেই, এত দিন থেকে আমার সাথে আছে, সে তো প্রায় ঘরের মানুষ, কিন্তু তবু আপনি নিয়েই যান। ছেলেটার শুধু যে জংবাহাদুরের সাথে খাতির তাই নয়, আজকাল তাকে দেখে দেখে বানরের মতো ব্যবহার করা শুরু করেছে।
আমি সান্ত্বনা দিয়ে বললাম, ছোট বাচ্চা যা-ই দেখে তা-ই শেখে, ওর আর দোষ কি? আর আপনি জংবাহাদুরকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করবেন না, সফদর আলী তাকে অনেক যত্ন করে রাখবেন। আপনার যখন দেখার ইচ্ছা হবে গিয়ে দেখতে পারেন, ইচ্ছা হলে। যখন খুশি বাসায় এনে যত দিন খুশি রাখতে পারেন। | ভদ্রলোকের মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, খুব খুশি হয়ে বললেন, হ্যা, হ্যা খুব ভালো। হয় তাহলে। মাঝে মাঝে বাসায় এনে কয়দিন রেখে ভালো করে খাইয়ে দেব, খুব খেতে পছন্দ করে বেচারা।
একটু পরেই জংবাহাদুর একটা শার্ট পরে হাজির হয়, তার মাথায় একটা হ্যাট, হাতে একটা টিনের বাক্স, ভেতরে নিশ্চয়ই তার স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি। তার গলায় দড়ি বাঁধা, দড়ির এক মাথা আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে ভদ্রলোককে লম্বা একটা সালাম করল। ভদ্রলোক জংবাহাদুরকে তুলে খানিকক্ষণ বুকে চেপে ধরে রেখে নামিয়ে দিলেন, আমি দেখলাম তাঁর চোখে প্রায় পানি এসে গেছে। আমি পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে সেখানে আমার বাসার ঠিকানা, অফিসের টেলিফোন নাম্বার লিখে। দিলাম। ভদ্রলোককে বললাম, আমাকে ফোন করলেই আমি তার সাথে জংবাহাদুরের দেখা করার ব্যবস্থা করে দেব।