এরপরে বানরের আকার-আকৃতি এবং স্বভাবের সুদীর্ঘ বর্ণনা রয়েছে। সফদর আলী আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন, আমার হাসি গোপন করার চেষ্টা তাঁর চোখে পড়ে গেল। তিনি কেন জানি হঠাৎ আমার উপর রেগে উঠলেন, মুখ কালো করে বললেন, আপনার চিঠি পড়ে হাসি পাচ্ছে? ঠিক আছে, এইটা পড়ে দেখেন হাসি পায় কি না।
সফদর আলী চিঠির বান্ডিল থেকে একটা খাম বের করে দিলেন, ভেতরের। চিঠিটা শুরু হয়েছে এভাবে :
শালা, তোমাদের আমি চিনি। তোমরা আমাদের দেশের বানর বিদেশে পাঠাও তার উপর অত্যাচার করার জন্যে। ভেবেছ আমি তোমাকে খুঁজে পাব না? ঠিকই আমি তোমাকে খুঁজে বের করব, তারপর কিলিয়ে তোমাকে আমি সিধে করব। তোমাদের মতো মানুষের চামড়া জ্যান্ত মিলিয়ে সেই চামড়া দিয়ে জুতো বানানো দরকার।
আকরম খান
এই চিঠিটা পড়ে আমি সত্যিই একটু ঘাবড়ে যাই, ভরসার কথা, যারা সামনাসামনি কথা না বলে এরকম উড়ো চিঠি পাঠায়, ব্যক্তিগত জীবনে তারা আসলে কাপুরুষ হয়। বানরের ওপর অত্যাচারের যে কথাটা লিখেছে সেটা অবশ্যি পুরোপুরি অমূলক নয়, পাশ্চাত্য দেশে যুদ্ধের সময় শক্রদেশের উপর ব্যবহার করার জন্যে যেসব বিষাক্ত রাসায়নিক তৈরি করা হয় সেগুলো বিভিন্ন পশুপাখি, বিশেষ করে বানরের উপর নাকি পরীক্ষা করে দেখা হয়। কিন্তু আমাদের নিরীহ সফদর আলীকে সেজন্যে দায়ী করার কী মানে থাকতে পারে?
আমি সফদর আলীকে সাহস দেয়ার জন্যে তাঁর দিকে তাকিয়ে হাসার চেষ্টা করি। সফদর আলী সেটা পুরোপুরি অগ্রাহ্য করে বললেন, মানুষের চামড়া দিয়ে জুতো হয় কখনো? মানুষের চামড়ার কোনো ইলাস্টিসিটি আছে? আছে?
আমি তাড়াতড়ি কিছু না বুঝেই বললাম, নেই, একেবারেই নেই। কোথেকে থাকবে?
তাহলে?
আমাকে স্বীকার করতেই হল আকরম খাঁ মানুষের চামড়া দিয়ে জুতো বানানোর কথা বলে খুবই অবিবেচকের মতো কথা বলেছেন। সফদর আলী খানিকক্ষণ গম্ভীর হয়ে বসে থেকে বললেন, আমি এর মাঝে নেই, আপনি যা ইচ্ছা হয় করতে পারেন।
আমি তাকে আশ্বস্ত করে বললাম, আপনি কিছু ভাববেন না, এখন থেকে সব দায়িত্ব আমার। আজ থেকে আমি পোস্ট অফিসে গিয়ে চিঠিগুলো আনব, খুলে পড়ে দেখব, যদি কোনো কাজের খবর থাকে আমি খোঁজ নিয়ে দেখব। আপনি নিশ্চিন্ত থাকেন।
সফদর আলী একটু শান্ত হলেন বলে মনে হল। খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, একটা জিনিস যদি না টেকে সেটা বানিয়ে লাভ আছে?
আমি থতমত খেয়ে বললাম, কিসের কথা বলছেন?
জুতোর কথা। মানুষের চামড়া কত পাতলা, সেই জুতো কি এক সপ্তাহের বেশি টিকবে? ভিনিগারে এক সপ্তাহ ভিজিয়ে রেখে, আলট্রাভায়োলেট রে দিয়ে ঘন্টাখানেক যদি শুকানো যায়—
আমি চা খেতে গিয়ে বিষম খেলাম, এই নাহলে আর বিজ্ঞানী।
সফদর আলীর বানরের সন্ধান চেয়ে বিজ্ঞাপনের উত্তরে যেসব চিঠি এল সেগুলো পড়ে আমি মানুষের চরিত্রের একটা নতুন দিক আবিষ্কার করলাম, মানুষ গাঁটের পয়সা খরচ করে শুধুমাত্র ঠাট্টা করার জন্যে চিঠি লিখতে ভারি পছন্দ করে। অসংখ্য চিঠিতে সফদর আলী এবং বানরকে নিয়ে কবিতা, কয়েকটি বেশ ভালো, ছন্দজ্ঞান প্রশংসা করার মতো। ঠিকানা দেয়া থাকলে আমি দেখা করে কবিতা লেখা চালিয়ে যাওয়ার জন্যে উৎসাহ দিয়ে আসতাম। অনেকে চিঠিতে কৌতূহলী হয়ে জানতে চেয়েছেন, নরকে দিয়ে কী করা হবে; অনেকে লিখেছে উপযুক্ত পারিশ্রমিক পেলে তারা বানর ধরে দেবে, কয়েকজন আবার আকরম খাঁর মতো ক্ষেপে বানরের ব্যবসা থেকে সরে পড়ার উপদেশ দিয়েছেন। আমি যখন আশা প্রায় ছেড়ে দিয়েছি তখন হঠাৎ একটা চিঠি এসে হাজির। চিঠিতে শান্তিনগর থেকে এক ভদ্রলোক লিখেছেন, তাঁর একটি বানর আছে, বানরটিকে যত্ন করে রাখার প্রতিশ্রুতি দিলে তিনি বানরটি দিয়ে দিতে পারেন। চিঠি পড়ে আমার খুশি দেখে কে! সফদর আলীর সেই চেহারা অনেক দিন থেকে ভুলতে পারছি না। সবচেয়ে বড় কথা, চিঠিটা ঢাকা থেকে লেখা, ইচ্ছা করলে আমি এখনই গিয়ে খোঁজ নিতে পারি। আমি আর দেরি করলাম না, বাসায় কেউ একজন এসে সন্ধ্যাটা মাটি করার আগেই আমি বের হয়ে পড়লাম।
শান্তিনগরে ভদ্রলোকের বাসা খুঁজে বের করে শুনি তিনি নেই, ঘন্টাখানেকের মধ্যে আসবেন। আমি সময় কাটানোর জন্যে খানিকক্ষণ এদিক-সেদিক ঘুরে বেড়ালাম। একটা চায়ের দোকানে এককাপ বিস্বাদ চা খেয়ে, একটা পানের দোকানে খানকয়েক আধুনিক গান শুনে, রাস্তার মোড়ে ঘাড় ব্যথা এবং মালিশের ওষুধের উপর একটা নাতিদীর্ঘ বক্তৃতা শুনে ঘন্টাখানেক পরে আবার ভদ্রলোকের বাসায় এসে হাজির হই। এবারে ভদ্রলোক বাসায় আছেন, খবর পাঠাতেই বের হয়ে এলেন, মোটাসোটা হাসিখুশি চেহারা। আমি বললাম, আপনার সাথে একটু কাজ ছিল।
আমার সাথে? কাজ? ভদ্রলোক অবাক হবার ভান করে বললেন, আমি এত অকাজের মানুষ, আমার সাথে আবার কারো কাজ থাকতে পারে নাকি! তারপর চিৎকার করে ভেতরে বললেন, এই, চা দে বাইরে।
আমি পকেট থেকে সফদর আলীকে লেখা তাঁর চিঠিটা বের করে বললাম, আপনি এই চিঠিতে লিখেছিলেন–
ও! আপনিই সফদর আলী! ভদ্রলোক আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, আমি ভেবেছিলাম আপনি আরো অনেক মোটা হবেন, ভূড়ি থাকবে, মাথায় টাক থাকবে আর গায়ের রংটা একটু ফর্সা হবে। বুঝলেন কি না, মানুষের নাম শুনলেই আমার চোখের সামনে তার চেহারাটা ভেসে ওঠে।
আমি বললাম, আমি সফদর আলী না, সফদর আলী আরেকজন, আমি তাঁর হয়ে এসেছি।