কেন, বগল থেকে বেরিয়ে আসবে।
আমি কল্পনা করলাম আমার বগল থেকে আরো দুটো হাত বেরিয়ে আসছে, কিন্তু ব্যাপারটা চিন্তা করেই আমার গায়ে কেমন জানি কাঁটা দিয়ে ওঠে।
বাড়তি হাত দুটোতে যে পাচটা করে আঙুল থাকতে হবে এমন কোনো কথা নেই; সফদর আলী গম্ভীর হয়ে বললেন, দুটো করে থাকলেই হয়, নখ কাটতে তা। এলে বেশি সময় নষ্ট হবে না।
যখন নিজেকে মোটামুটি বিশ্বাস করিয়ে এনেছি যে সত্যি মানুষের চারটা হাতের দরকার, তখন হঠাৎ আমার অন্য একটা সম্ভাবনার কথা মনে হল, একটু ভয়ে ভয়ে বললাম, কথাটা আপনি হয়তো ঠিকই বলেছেন, কিন্তু–
দুই আঙুলের কথা তো, আমি–
না, আমি চার হাতের কথা বলছিলাম। আপনার কথা ঠিক, চার হাত হলে কাজকর্মে অনেক সুবিধে, কিন্তু চারটা হাতই যে একজন মানুষের হতে হবে এমন তো কোনো কথা নেই।
মানে?
আপনি খুঁজে পেতে একটা সহকারী নিয়ে নেন, তাহলেই আপনাদের দু’জনের মিলে চারটা হাত হয়ে যাবে।
ঠিক বলেছেন, সফদর আলীর মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, কিন্তু মাত্র কয়েক মুহূর্তের জন্যে। হঠাৎ কী একটা মনে পড়ে যায় আর তিনি গম্ভীর হয়ে মাথা নাড়তে থাকেন।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, কী হল?
সহকারী নেয়া যাবে না।
কেন?
সফদর আলী গলা এত নামিয়ে আনলেন যে কথা প্রায় শোনা যায় না, ফিসফিস করে বললেন, অনেক গোপন জিনিসের উপর গবেষণা করি তো, জানাজানি হয়ে গেলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। এই যে কিকুলমুকাসের কথা বলছি, সেটা যদি কেউ জেনে ফেলে, কী সর্বনাশ হবে আপনি জানেন?
সফদর আলী এত গম্ভীর হয়ে মাথা নাড়তে থাকেন যে দেখে আমিও ঘাবড়ে যাই। এরপর আর কথাবার্তা জমল না, তিনি গম্ভীর হয়ে মাথা নাড়ছেন আমি পিছু-পিছু হাঁটছি—এরকম আর কতক্ষণ চলতে পারে? নবাবপুরের মোড়ে এসে আমি একটা বাস নিয়ে নিলাম, সফদর আলী যাত্রাবাড়ির দিকে রওনা দিলেন, সেখানে তাঁর নাকি কি দরকার।
দু’ দিন পরের কথা। বিকেলে বাসায় এসে শুনি আমার নাকি একটা টেলিগ্রাম এসেছে। টেলিগ্রামে জরুরি কিছু আছে ভেবে ভয়ের চোটে তাড়াতাড়ি সবাই মিলে সেটা খুলে ফেলেছে, কিন্তু পড়ে এখন কেউ কিছু বুঝতে পারছে না। বুঝতে পারার কথা নয়। কারণ টেলিগ্রামে লেখা :
চার হাতের প্রয়োজন নাই। দুই হাত এবং দুই হাত যথেষ্ট।
আপনি ঠিক। কিন্তু সহকারী নয়। সহজ সমাধান। কাওরান বাজার। সন্ধ্যা সাতটা।
নিচে কোনো নাম লেখা নেই, কিন্তু বুঝতে কোনো অসুবিধে হল না এটা কার কাজ। টেলিগ্রাম করতে তাঁকে বাসে কিংবা রিকশায় যত দূর যেতে হয়েছে, বাসার দূরত্ব তার অর্ধেকও নয়, কিন্তু তাঁকে সেটা কে বোঝাবে? বাসার সবাই জানতে চাইল ব্যাপারটা কি, আমি বোঝালাম আমার এক বন্ধুর রসিকতা। আমার বন্ধুদের সম্পর্কে বাসার সবার খুব উচ্চ ধারণা আছে সেরকম দাবি করব না, কাজেই ব্যাপারটা বিশ্বাস করাতে বেশি বেগ পেতে হল না।
সাতটার সময় কাওরান বাজারে চায়ের দোকানে হাজির হয়ে দেখি সফদর সাহেব টেবিলে একটা কাগজ বিছিয়ে সেখানে কী যেন একটা আঁকিজুকি করছেন। আমাকে দেখে তাড়াতাড়ি সেটা ভাঁজ করে পকেটে লুকিয়ে ফেললেন। আমি পাশে গিয়ে বসতেই গলা নামিয়ে বললেন, বানর, বানর হচ্ছে সমাধান!
কী বললেন?
বললাম বানর।
বানর? কিসের বানর?
কিসের আবার হবে, সফদর আলী একটু অসহিষ্ণু স্বরে বললেন, আমার একটা। বানর দরকার।
আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, বানর দিয়ে কী করবেন?
আপনি বলছিলেন না সহকারীর কথা? বানর হবে আমার সহকারী। আগে শুধু একটু শিখিয়ে পড়িয়ে নিতে হবে।
বানরকে শিখিয়ে পড়িয়ে নেবেন? আমি উচ্চস্বরে হাসতে গিয়ে থেমে গেলাম, আমার হঠাৎ গিনিপিগকে দিয়ে কাচ্চি বিরিয়ানি রান্না করার কথা মনে পড়ে গেল। সফদর আলী যদি গিনিপিগকে দিয়ে বিরিয়ানি রান্না করিয়ে নিতে পারেন, কে জানে সত্যিই হয়তো বানরকে শিখিয়ে পড়িয়ে সহকারী বানিয়েও নিতে পারবেন। তবু ব্যাপারটা ঠিক বিশ্বাস হতে চায় না, একটু কেশে বললাম, বানরকে দিয়ে কী কী কাজ করানোর কথা ভাবছেন?
কঠিন কিছু নয়, সহজ কাজ। এই সকালে দু’টি রুটি টোস্ট করে এককাপ চা তৈরি করে দেবে, ঘরদোর একটু পরিষ্কার করবে, দুপুরে চিঠিপত্র গুলো আনবে–এইসব ছোটখাট কাজ।
আমি কল্পনা করার চেষ্টা করলাম, সফদর আলী বসে আছেন আর একটা বানর তাঁর জন্যে কড়া লিকারের চা তৈরি করছে!
আসল কাজ অবশ্যি আমার গবেষণা, সফদর আলী চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন, বানরকে দরকার সেজন্যে।
বানরের উপর গবেষণা?
না না, বানরের উপর আর নতুন কী গবেষণা হবে, সে তো প্রায় শেষ। আমি আমার নিজের গবেষণার কথা বলছি। বানর আমার গবেষণায় সাহায্য করবে, সে হবে আমার বাড়তি দুই হাত। মনে করেন কিকুলমুকাসটা খুলতে চাই, বলব, বান্দর আলী, স্ক্রু-ড্রাইভারটা নিয়ে এস তো—
বান্দর আলী?
সফদর আলী লাজুকভাবে হেসে বললেন, নামটা খারাপ হল?
না, খারাপ হবে কেন, চমৎকার নাম! আমি হাসি গোপন করে জিজ্ঞেস করলাম, পশুপাখিকে এভাবে কাজকর্ম শেখানো কি খুব কঠিন নাকি?
সেটা নির্ভর করে কী ধরনের পশু তার উপর, সফদর আলী একটা লম্বা বক্তৃতা দেয়ার জন্যে প্রস্তুত হলেন, যদি ম্যামেল বা স্তন্যপায়ী প্রাণী হয়, তা হলে খুবই সহজ। ম্যামেলদের ভেতরে বানরের বুদ্ধি আবার অন্যদের থেকে বেশি, কাজেই বানরকে শেখানো একেবারে পানিভাত। পদ্ধতিটা হচ্ছে পুরস্কার পদ্ধতি, ট্রেনিং দেবার সময়ে যখনি একটা কাজ ঠিকভাবে করে তখনি পুরস্কার দিতে হয়। মনে করেন আপনি একটা বানর, আমি আপনাকে বললাম, বান্দর আলী, স্ক্রু-ড্রাইভারটা নিয়ে এস তো। আপনি তখন আমার কথা কিছু না বুঝে লাফ-ঝাঁপ দেয়া শুরু করবেন। আমি তখন চেষ্টা করব আপনাকে স্ক্রু-ড্রাইভারের কাছে নিয়ে যেতে। লাফ-ঝাঁপ দিতে দিতে হঠাৎ যদি ভুলে স্তু-ড্রাইভারটা ছুঁয়ে ফেলেন, সাথে সাথে আপনাকে পুরস্কার হিসাবে একটা কলা দেব। এরকম কয়েকবার যদি করি তখন আস্তে আস্তে আপনি বুঝতে পারবেন স্ক্রু-ড্রাইভার কথাটা শুনে আপনি যদি স্ক্রু-ড্রাইভারটা গিয়ে ধরেন, তা হলে আপনি একটা কলা পাবেন। কলার লোভে এরপরে যখনই আমি বলব স্ক্রু-ড্রাইভার, আপনি ছুটে যাবেন স্ক্রু-ড্রাইভারটা ধরতে। এভাবে আস্তে আস্তে অগ্রসর হতে হয়। প্রথমে ড্রাইভারটা ধরলেই আপনাকে একটা কলা দেব, কিন্তু পরে কলা পেতে হলে আপনাকে স্ক্রু-ড্রাইভারটা আমার কাছে নিয়ে আসতে হবে। বুঝতে পারলেন তো ব্যাপারটা?