এইটা আপনার বানর?
গলার স্বরে আমি চমকে তাকাই, খালি গায়ে তেল চিকচিকে একটা মানুষ গালে হাত দিয়ে মেঝেতে বসে আছে। নিশ্চয় চোর হবে, দেখে মনে হয় দিব্যি একটা ভালোমানুষ।
সফদর আলী গম্ভীর মুখে জবাব দিলেন, হ্যাঁ।
লোকটা দাঁত দিয়ে নখ কাটতে কাটতে বলল, আমি যদি এই বেটার জান শেষ না করি তাহলে আমার নাম ইদরিস মোল্লা না।
আমি কৌতূহলী হয়ে এগিয়ে এলাম, কেন, কি হয়েছে?
জিজ্ঞেস করতে হয় কেন? লোকটা ভীষণ রেগে ওঠে, আপনার পোষা বানর যদি আপনাকে ইলেকট্রিক শক দিয়ে মজা দেখায়, তাহলে আমার কী অবস্থা করেছে বুঝতে পারেন না?
সফদর আলী মুখ শক্ত করে বললেন, নিশ্চয়ই তুমি পালানোর চেষ্টা করেছিলে।
লোকটা মুখ ভেংচে উত্তর দিল, সেটা খুব অন্যায় হয়েছে? আপনি লোক জড়ো করে মারপিট করার ব্যবস্থা করলে দোষ হয় না, আর আমি পালানোর চেষ্টা করলে দোষ?
চোর বেচারা আমাকে দেখে মনে করেছে তাকে পিটুনি দিতে এসেছি। আমার চেহারা এমন যে দেখলেই মনে হয় কাউকে ধরে বুঝি মার দিয়ে দেব। ছোট বাচ্চারা এ জন্যে পারতপক্ষে আমার ধারে-কাছে আসে না। শুনেছি আমার পরিচিত কিছু ছোট বাচ্চাকে আমার কথা বলে ভয় দেখিয়ে ঘুম পাড়ানো হয়। যাই হোক, আমি চোরটার ভূল ভেঙে না দিয়ে একটা হুঁঙ্কার দিয়ে পাশের ঘরে ঢুকিয়ে তালা মেরে আটকে দিলাম। এখন পুলিশে খবর দিতে হবে। তার সাথে আমার অন্য কৌতূহল রয়ে গেছে। সফদর আলীকে জিজ্ঞেস করলাম, মোরগগুলো কোথায়?
সফদর আলী ইতস্তত করে বললেন, ঐ তো, ঐ ঘরে।
একটু দেখে আসি।
সফদর আলী অনিচ্ছার স্বরে বললেন, যাবেন দেখতে?
কী আছে, দেখে আসি।
সফদর আলী না করলেন না, কিন্তু খুব অস্বস্তি নিয়ে গোঁফ টানতে থাকেন।
আমি দরজা খুলে ঘরটাতে ঢুকলাম। অন্ধকার ঘর, একটা চাপা দুর্গন্ধ, মোরগের ঘরে যেমন হবার কথা। দেয়াল হাতড়ে বাতির সুইচ না পেয়ে হঠাৎ মনে পড়ল তার বাসায় হাততালি দিলেই বাতি জ্বলে ওঠে। আমি শব্দ করে একটা হাততালি দিলাম আর সত্যিই সাথে সাথে বাতি জ্বলে উঠল। না জ্বললেই ভালো ছিল, কারণ তখন যে। দৃশ্য দেখতে হল, মানুষের পক্ষে সে দৃশ্য সহ্য করা সম্ভব না।
আমি আতঙ্কে পাথর হয়ে গেলাম। আমার চারদিকে থলথলে আশ্চর্য এক ধরনের প্রাণী। প্রাণীগুলোর গোল গোল বড় বড় চোখ, ড্যাবড্যাব করে স্থির চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। প্রাণীগুলো আমাকে কয়েক মুহূর্ত পর্যবেক্ষণ করে, তারপর হঠাৎ একসাথে খাই খাই করে থলথলে শরীর টেনে-হিচড়ে আমার দিকে এগুতে থাকে। সফদর আলী মোরগের কথা বলেছিলেন। কিন্তু এগুলো তো মোরগ নয়, এগুলো সাক্ষাৎ পিশাচ। আতঙ্কে চিৎকার করে আমি পালানোর চেষ্টা করি—তারপর আর কিছু মনে নেই।
যখন জ্ঞান হল তখন দেখি সফদর আলী মুখে পানির ঝাঁপটা দিচ্ছেন। ওপরে চশমা চোখে জংবাহাদুর ঘুলঘুলি ধরে ঝুলে আছে, আবার সে পেট চেপে হেসে। গড়াগড়ি খাচ্ছে। আমাকে চোখ খুলতে দেখে সফদর আলী স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, তখনি বলেছিলাম গিয়ে কাজ নেই, ভয় পেতে পারেন।
আমি চিঁ চিঁ করে বললাম, ওগুলো কী?
কেন, মোরগ।
ওরকম কেন?
ভাবলাম মোরগ রান্না করতে হলে যখন পালক ছাড়াতেই হয়। আগে থেকে ওষুধ দিয়ে পালক ঝরিয়ে ফেললে কেমন হয়। পালক ঝরে যাবার পর দেখতে খারাপ হয়ে গেল। তা ছাড়া মোটা হওয়ার ওষুধটা একটু বেশি হয়ে সবগুলো বাড়াবড়ি মোটা হয়ে গেছে। মোটা বেশি বলে খিদেও বেশি, সবসময়েই এখন খাই খাই। যা-ই দেখে তা-ই। খেতে চায়, মানুষজন দেখলেও চেষ্টা করে খেতে।
আমি সাবধানে বুকের ভেতর আটকে থাকা একটা নিঃশ্বাস বের করে দিই। কতদিন, ঐ দৃশ্য মনে থাকবে কে জানে!
পরের ইতিহাস সংক্ষিপ্ত। চোরকে থানায় দেবার পর তার বাসা থেকে সফদর আলীর চোর ধরার যন্ত্রসহ অনেক চোরাই মালপত্র উদ্ধার করা হয়েছে। সফদর আলী মিউনিসিপ্যালিটি থেকে চোর ধরার জন্যে কী একটা পুরস্কার পেতে পারেন বলে শুনেছি। তিনি এখনো গবেষণা করে যাচ্ছেন মোরগগুলোকে আগের চেহারায় ফিরিয়ে আনতে। জিনিসটি অসম্ভব নয়, কিন্তু বেশ নাকি কঠিন। আমি অবশ্যি খুব আশাবাদী নই। তাঁর ইনকিউবেটর অবশ্যি ঠিক আছে। আমি আপাতত সেটাই সাধারণ মানুষের। কাছে বিলি করানো যায় কি না বোঝানোর চেষ্টা করছি।
দেখি কি হয়!