তাই বলেন, আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলি, চোরকে তাহলে আসলে জংবাহাদুরের হাতে ঠিক ছেড়ে আসেন নি।
না, তা ঠিক নয়, জংবাহাদুরের হাতেই ছেড়ে এসেছি। হাই ভোল্টেজের সুইচটা জংবাহাদুরের হাতে, সে ইচ্ছা করলে চালু করবে, ইচ্ছা করলে বন্ধ করবে।
করেছেন কী! আমি লাফিয়ে উঠি, একটা বানরের হাতে এভাবে ছেড়ে আসা উচিত হয় নি। চোর নিশ্চয়ই পালিয়ে গেছে এতক্ষণে।
মনে হয় না, সফদর আলী গম্ভীর গলায় বললেন, জংবাহাদুর ভীষণ চালু, ওকে ধোঁকা দেওয়া মুশকিল।
কি জানি বাবা, আমার বানরের ওপর এত বিশ্বাস নেই। তাড়াতাড়ি চলে যাই।
আমি দুই মিনিটে প্রস্তুত হয়ে বেরিয়ে পড়ি। ভোরের ঘুমটা গেল, কিন্তু রোজ তো আর চোর ধরা পড়ে না, রোজ তো আর সফদর আলী একটা বানরের হাতে একটা। ধড়িবাজ চোর ছেড়ে আসেন না!
ভেবেছিলাম হেঁটে যেতে হবে। কিন্তু একটা রিকশা পেয়ে গেলাম। এত সকালে বেচারা রিকশাওয়ালা রিকশা নিয়ে বেরিয়েছে কেন কে জানে! আমি রিকশায় উঠে। সফদর আলীকে জিজ্ঞেস করলাম, নতুন আরেকটা চোর ধরার যন্ত্র তৈরি করেছেন তাহলে?
নাহ! সফদর আলী হঠাৎ করে কেমন জানি কাঁচুমাচু হয়ে যান।
তাহলে? আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করি, চোর ধরা পড়ল কেমন করে?
সফদর আলী কাঁচমাচু মুখেই একটু ইতস্তত করে বলেই ফেললেন, বেচারা চোর ভুল করে সেই মোরগের ঘরে ঢুকে পড়েছিল।
এই প্রথম তিনি নিজে থেকে মোরগের কথা বললেন। আমি নিঃশ্বাস বন্ধ করে থাকি শোনার জন্যে তিনি কী বলেন। কিন্তু সফদর আলী আর কিছুই বললেন না। আমি বাধ্য হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, তারপর কী হল?
কী আর হবে, ভয়ে এক চিৎকার করে ফিট।
আমার চোয়াল ঝুলে পড়ে, ভয়ে চিৎকার করে ফিট?
হ্যাঁ। মোরগ দেখে ফিট?
ও বেচারা কি আর জানে নাকি ওগুলো মোরগ। ও ভেবেছে—
কী ভেবেছে?
কি জানি, কি ভেবেছে। সফদর আলী হাত নেড়ে থেমে পড়তে চাইলেন, কিন্তু আমি চেপে ধরলাম। সফদর আলী বাধ্য হয়ে সবকিছু খুলে বললেন, ঘটনাটা এরকম–
আমি বগুড়া চলে যাবার পরপরই সফদর আলীর মনে হল ছোট একটা জায়গায় এতগুলো মোরগের বাচ্চা পাশাপাশি থাকাটা তাদের মানসিক অবস্থার জন্যে ভালো নয়। যেহেতু তাদের জন্যে জায়গা বাড়ানো সম্ভব নয়, তাই তিনি ঠিক করলেন মোরগের বাচ্চাগুলিকে এমন একটা অনুভূতি দেবেন যেন তারা অনেক বড় একটা জায়গায় আছে। ত্রিমাত্রিক সিনেমা দেখানোর জন্যে যেরকম ব্যবস্থা করা হয় তিনিও সেই একই ব্যবস্থা করলেন। ঘরের চারপাশের দেয়ালে গাছপালা-বাড়িঘর ইত্যাদির দুইটি করে ছবি এঁকে দিলেন। একটি লাল রং দিয়ে, আরেকটি সবুজ। ছবি দুটির মাঝখানে একটু ফাঁক রাখা হল, যেখানে ফাঁক যত বেশি, সেখানে ছবিটাকে মনে হবে তত বেশি দূরে। দূরত্বের এই অনুভূতি আনার জন্যে অবশ্যি একটা বিশেষ ধরনের চশমা পরতে হয়। এই চশমার একটা কাচ সবুজ, আরেকটা লাল। এই চশমা পরে লাল আর সবুজ রঙের আঁকা ছবিটির দিকে তাকালে দুই চোখ দিয়ে দুটি আলাদা আলাদা ছবি দেখতে পায়। এক চোখে দেখে লাল রঙে আঁকা ছবি অন্য চোখে দেখে সবুজ রঙে আঁকা ছবি। আমরা কখনোই দুই চোখ দিয়ে দুটি আলাদা আলাদা জিনিস দেখি না। এবারেও মস্তিষ্ক চোখ দুটিকে বাধ্য করে দূরে এক জায়গায় একান্তে যেন দুটি ছবি একত্র হয়ে একটি ছবি হয়ে যায়। কাজেই ছবিটি দেখা যায় ঠিকই, কিন্তু মনে হয় দূরে। আর তাই দেয়ালে আঁকা ছবিগুলোকে মনে হবে অনেক দূরে ছড়ানো।
দেয়ালে ছবি আঁকা শেষ করে সফদর আলী মোরগের চশমা তৈরি শুরু করলেন, তখন হঠাৎ তাঁর মনে পড়ল মোরগের দুই চোখ দুই পাশে, মানুষের মতো সামনে নয়। দুই চোখ সামনে না থাকলে দূরত্ব বোঝা যায় না। কাজেই সফদর আলীর মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। সফদর আলী অবশ্যি হাল ছাড়ার মানুষ নন। তাই তিনি একটা সমাধান ভেবে বের করলেন। ছোট ছোট দুটি আয়না তিনি পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি কোণ করে চোখের দু’ পাশে লাগিয়ে দিলেন। মোরগের এভাবে দেখে অভ্যাস নেই, তাই সেগুলো প্রথম কয়দিন অন্ধের মতো এদিকে-সেদিকে ঘুরে বেড়াতে থাকে। যখন ডানদিকে যাবার কথা তখন বামদিকে যায়। আবার যখন বামদিকে যাবার কথা তখন যায় ডানদিকে। সপ্তাহখানেক পরে সেগুলোর একটু অভ্যাস হল, তখন একটা ভারি মজার ব্যাপার দেখা যায়, মোরগগুলো ক্রমাগত মাথা না নেড়ে সবসময় একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে। সফদর আলীর মতে জিনিসটা দেখতে খুবই অস্বাভাবিক, আগে থেকে জানা না থাকলে ভয় পাওয়া মোটেও বিচিত্র নয়। মোরগের চোখ দুটি সামনের দিকে এনে তাদের বাইনোকুলার দৃষ্টি দেবার পর তিনি তাদের চশমা পরাতে শুরু করলেন। এক চোখে লাল আরেক চোখে সবুজ চশমার কাচে মোরগগুলোকে দেখতে ভয়ংকর দেখাতে থাকে। কিন্তু তারা নাকি দূরত্বের অনুভূতি পাওয়ার ফলে হঠাৎ করে মানসিকভাবে ভালো বোধ করতে শুরু করে। সফদর আলী সেটা কী ভাবে জেনেছেন জিজ্ঞেস করলে মাথা চুলকে প্রশ্নটা এড়িয়ে গেছেন।
মোরগগুলোর ওপর সফদর আলী আরো কী কী গবেষণা করেছেন সেটা বলে শেষ করার আগেই আমরা তাঁর বাসায় পৌঁছে যাই। সফদর আলী রিকশার ভাড়া মিটিয়ে দরজার কাছে গিয়ে একটা হাঁক দিলেন, জংবাহাদুর, হাই ভোল্টেজ বন্ধ করে দাও, একদম বন্ধ!
জংবাহাদুর নিশ্চয়ই হাই ভোন্টেজ বন্ধ করে দিয়েছে। কারণ সফদর আলী ইলেকট্রিক শক না খেয়েই ভেতরে এসে ঢুকলেন। পিছু পিছু আমিও ঢুকছিলাম। কিন্তু হঠাৎ প্রচণ্ড ইলেকট্রনিক শক খেয়ে সফদর আলী আর আমি দশ হাত দূরে ছিটকে পড়ি। কয়েক মুহূর্ত লাগে আমার সম্বিৎ ফিরে পেতে। প্রথমেই দেখতে পেলাম ঘুলঘুলিতে জংবাহাদুর ঝুলে আছে। চোখে চশমা এবং সেই অবস্থায় সে পেট চেপে হাসিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। সফদর আলী কাপড়ের ধুলা ঝাড়তে ঝাড়তে উঠে বললেন, কেমন পাজি দেখেছেন বেটা বানর?