আমি বললাম, এই তো চলে যাচ্ছে কোনোরকম। আপনার কী খবর? চোর ধরার যন্ত্র শেষ হয়েছে?
আজকাল আমি মোরগের বাচ্চার কথা তুলি না। সফদর আলী মাথা চুলকে বললেন, হ্যাঁ, শেষ তো হয়েছিল।
লাগিয়েছেন চোর ধরার জন্যে?
হ্যাঁ, লাগিয়েছিলাম।
চোর এসেছিল?
সফদর আলী মাথা চুলকে বলল, হ্যাঁ, এসেছিল।
ধরা পড়েছে।
না।
তাহলে জানলেন কেমন করে যে এসেছিল?
সফদর আলী আবার মাথা চুলকে বললেন, জানি এসেছিল, কারণ পুরো যন্ত্রটা চুরি করে নিয়ে গেছে।
আমার একটু কষ্ট হল হাসি গোপন করতে। চোর যদি চোর ধরার যন্ত্র চুরি করে নিয়ে যায় ব্যাপারটাতে একটু হাসা অন্যায় নয়। সফদর আলী আমার হাসি গোপন করার চেষ্টা দেখে কেমন জানি রেগে উঠলেন, বললেন, আপনি হাসছেন? জানেন আমার কত কষ্ট হয়েছে ওটা তৈরি করতে? কত টাকার যন্ত্রপাতি ছিল আপনি জানেন?
আমি বললাম, কে বলল আমি হাসছি? এটা কি হাসির জিনিস? কী ভাবে নিল চোর এটা?
সফদর সাহেব মাথা চুলকে বললেন, সেটা এখনো বুঝতে পারি নি। জিনিস মেঝের সাথে স্তু দিয়ে আঁটা ছিল, পুরোটা খুলে নিয়ে গেছে। ভাগ্যিস জংবাহাদুর ছিল, নইলে সব চুরি করে নিত।
জংবাহাদুর কেমন আছে আজকাল?
ভালোই আছে, দিনে দিনে আরো অলস হয়ে যাচ্ছে।
চোখ খারাপ হয়ে চশমা নিয়েছে বলেছিলেন?
হ্যাঁ। মানুষের মতো নাক নেই তো, চশমা পরতে প্রথম প্রথম অনেক ঝামেলা হয়েছিল জংবাহাদুরের।
আমার হঠাৎ জিনিসটা খেয়াল হয়, সত্যিই তো, বানরের চশমা আটকে থাকবে। কোথায়? জিজ্ঞেস করলাম, কী ভাবে পরে চশমা?
সফদর আলী একটু হাসলেন, বললেন, সেটা আর কঠিন কী? মোরগের চশমা তৈরি করে দিলাম, আর এটা তো বানর।
আমি চমকে ঘুরে তাঁর দিকে তাকাই, মোরগের চশমা?
সফদর আলী হঠাৎ অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন। তাঁর মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল। আমতা-আমতা করে অপ্রাসঙ্গিকভাবে বললেন, কেমন গরম পড়ে যাচ্ছে দেখেছেন?
তখন মোটেও গরম পড়ছে না, দু’দিন থেকে আমার হাফহাতা সোয়টারটা আর শীত মানতে চাইছে না বলে একটা ফুলহাতা সোয়েটার পরব বলে ভাবছি। কাজেই বুঝে নিলাম সফদর আলী কথাটা ঘোরাতে চাইছেন। সফদর আলী ভুলে মোরগের চশমার কথা বলে ফেললেন, এখন আর কিছুতেই মুখ খুলবেন না। আমি তাঁকে আর ঘাঁটালাম না, কথাটা কিন্তু আমার মনে গেঁথে রইল। মোরগের চশমা পরিয়ে তিনি একটা-কিছু অঘটন ঘটিয়েছেন। অঘটনটি কী জানার জন্যে কৌতূহলে আমার পেট ফেটে যাওয়ার অবস্থা। কিন্তু লাভ কি? সফদর আলী তো কিছুতেই কিছু বলবেন না।
মাঝরাতে কেউ যদি কাউকে ডেকে তোলে, তার মানে একটা অঘটন। কখনো শুনি নি। কাউকে মাঝরাতে ডেকে তুলে বলা হয়েছে সে লটারিতে লাখ-দু’ লাখ টাকা পেয়েছে। তাই আমাকে যখন মাঝরাতে ডেকে তুলে বলা হল, আমার সাথে এক জন দেখা করতে এসেছে, ভয়ে আমার আত্মা শুকিয়ে গেল। কোনোমতে লুঙ্গিতে গিট মেরে চোখ মুছতে মুছতে এসে দেখি সফদর আলী। আগে কখনো আমার বাসায় আসেন নি, এই প্রথম, সময়টা বেশ ভালোই পছন্দ করেছেন। আমি খানিকক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে। থেকে বললাম, কী ব্যাপার সফদর সাহেব, এত রাতে?
রাত কোথায়? এ তো সকাল, একটু পরেই সূর্য উঠে যাবে।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি কথাটা খুব ভুল নয়, ভোর চারটার মতো বাজে, ঘন্টাখানেক অপেক্ষা করলে সূর্য যদি নাও ওঠে, চারিদিক ফর্সা হয়ে যাবে ঠিকই। এই সময়টাতে আমার ঘুম সবচেয়ে গাঢ়। লাখ টাকা দিলেও এই সময়ে আমি ঘুম নষ্ট করি না। আজ অবশ্যি অন্য কথা, বসতে বসতে জিজ্ঞেস করলাম, কোনো কাজে এসেছেন, না এমনি হাঁটতে হাঁটতে চলে এসেছেন?
সফদর আলী একটু রেগে বললেন, এমনি হাঁটতে হাঁটতে কেউ এত রাতে আসে নাকি?
আপনিই না বললেন এখন রাত নয়, এখন সকাল। ভাবলাম বুঝি আনার মর্নিং-ওয়াক করার অভ্যাস।
আরে না না, মর্নিং-ওয়াক না, একটা ব্যাপার হয়েছে।
কি ব্যাপার?
একটু আগে সেই চোর ধরা পড়েছে। এখন তাকে নিয়ে কি করি বুঝতে না। পেরে
আমি আঁৎকে উঠে বললাম, তাকে সাথে নিয়ে এসেছেন?
না, কী যে বলেন। কোথায় সেই চোর?
বাসায়। সফদর আলী মাথা চুলকে বললেন, চোর ধরা পড়লে কী করবে। জানেন?
আমি মাথা চুলকাই, চোর ধরা পড়লে লোকজন প্রথমে একচোট মারপিট ক; নেয় দেখেছি। যাকে সারা জীবন নিরীহ গোবেচারা ভালোমানুষ বলে জেনে এসেছি, সেও চোর ধরা পড়লে চোখের সামনে অমানুষ হয়ে কী মারটাই না মারে! কিন্তু সেটা তো আর সফদর আলীকে বলতে পারি না। একটু ভেবে-চিন্তে বললাম, চোর ধরা পড়লে মনে হয় পুলিশের কাছে দিতে হয়।
সে তো সবাই জানে, কিন্তু দেয়টা কী ভাবে? চোর তো আর ওষুধের শিশি না যে পকেটে করে নিয়ে যাব। রিকশায় পাশে বসিয়ে নেব? যদি দৌড় দেয় উঠে?
বেঁধে নিতে হয় মনে হয়।
কোথায় বাঁধব?
হাতে।
হাত বাঁধা থাকলে মানুষ দৌড়াতে পারে না বুঝি?
আমি মাথা চুলকে বললাম, তাহলে মনে হয় পায়ে বাঁধতে হবে।
সফদর আলী ভুরু কুঁচকে বললেন, তাহলে ওকে নিয়ে যাব কেমন করে? কোলে করে?
সমস্যা গুরুতর। আমার মাথায় কোনো সমাধান এল না, জিজ্ঞেস করলাম, এখন কোথায় রেখে এসেছেন?
জংবাহাদুরের কাছে।
আমি অবাক হয়ে প্রায় চেচিয়ে উঠি, একটা বানরের কাছে একটা ঘাগু চোর রেখে এসেছেন! মাথা খারাপ আপনার?
সফদর আলী অবাক হয়ে বললেন, তাহলে কী করব? সাথে নিয়ে আসব?
কিন্তু তাই বলে একটা বানরের কাছে রেখে আসবেন?
আহা-হা, এত অস্থির হচ্ছেন কেন, আমি কি এমনি এমনি রেখে এসেছি, ঘরের সব দরজা-জানালাতে এখন বিশ হাজার ভোল্ট, পাওয়ার বেশি নেই তাই কেউ ছুঁলে কোনো ক্ষতি হবে না। কিন্তু দারুণ শক খাবে।