ছয় ডেকচি বিরিয়ানি রান্না হয়ে আছে। আমরা সেগুলো বাইরে বিতরণ করে দিয়ে এলাম। কয়েকজন জিজ্ঞেস করল, কাল কখন আসবে। সফদর আলী যখন বললেন, আর আসতে হবে না—তারা বেশ অবাক হল। এক জন তো একটু রেগেই গেল মনে হল, সে নাকি দেশে চিঠি লিখে দিয়েছে, তার পরিবারের অন্য সবার আজ রাতে পৌঁছে যাবার কথা! সে এখন কী করবে সফদর আলীর কাছে জানতে চাইল, সফদর আলী কিছু বলতে পারলেন না! দরজায় তালা মেরে আমাকে নিয়ে একটা রিকশা নিলেন, অনেকদিন জিলিপি খাওয়া হয় না, আজ জিলিপি খাওয়া হবে
শেষ খবর অনুযায়ী সফদর আলী তাঁর এক হাজার গিনিপিগকে জমি চাষ করা শেখাচ্ছেন। তাঁর বাসার পিছনে খালি জায়গা আছে, সেখানে নাকি তারা আলু, ফুলকপি আর টমেটো লাগাচ্ছে! একটু বড় হলেই আমাকে দেবেন বলেছেন। আমি অপেক্ষা করে আছি। আজকাল সবজির যা দাম!
০২. জংবাহাদুর
সদরঘাটে পুরানো লোহা-লক্কড়ের দোকানে সফদর আলীর সাথে আমার দেখা, মোটা লোহার হাতলের মতো দেখতে বিদঘুটে একটা জিনিস দরদাম করছিলেন। এরকম একটা জিনিস মানুষের কোনো কাজে লাগতে পারে, না দেখলে বিশ্বাস হয় না। কাছে গিয়ে তাঁর কাঁধে হাত রাখতেই তিনি ভীষণ চমকে ঘুরে তাকালেন, আমাকে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, ও আপনি! আমি আরো ভাবলাম—
কী ভাবলেন?
সফদর আলী কথা শেষ না করে সন্দেহের দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে হঠাৎ থেমে গেলেন, বললেন, নাহ, কিছু না।
সফদর আলী তাঁর অভ্যাসমতো কথাটা এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করছেন দেখে আমি আর ঘাঁটালাম না। তাঁকে কেমন জানি একটু উদভ্রান্তের মতো দেখাচ্ছে, চেহারায় কেমন একটু উড়ো উড়ো ভাব, ভালো করে তাকিয়ে দেখি বাম হাতের বুড়ো আঙুলে একটা ব্যান্ডেজ। জিজ্ঞেস করলাম, আপনার আঙুলে কী হল?
আর বলবেন না, কিকুলমুকাসের স্কু লাগাচ্ছিলাম, এমন সময় একটা মশা কামড় দিল ঘাড়ে, একটু নড়তেই ডালাটা খুলে এসে বুড়ো আঙুলটাকে থেতলে দিয়েছে।
কিকুলমুকাস কী জিনিস জিজ্ঞেস করব কি না ভাবছিলাম, তার আগেই সফদর আলী আমাকে হাতলটা দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কুড়ি টাকা চাইছে, নিয়ে নেব নাকি, কী বলেন আপনি?
আমি আঁৎকে উঠে বললাম, মাথা খারাপ আপনার? কুড়ি টাকা এই বিদটে হাতলটার জন্যে? আমাকে তো কেউ বিনে পয়সায় দিলেও এটা নেব না। চলেন, চলেন এখান থেকে আমি তাঁকে সেখানে থেকে টেনে সরিয়ে নেবার চেষ্টা করি।
দোকানি আমার কথায় একটু মনঃক্ষুন্ন হল বলে মনে হল; বলল, কী বলেন স্যার, খাঁটি আমেরিকান স্টিল, ডান্ডা মারলেও কিছু হবে না। ফাইটিং প্লেনের পার্টস, কেনা দামে দিয়ে দিচ্ছিলাম। নেন, না হয় আরো দুই টাকা কম দেবেন।
সফদর আলী চোখ ছোট করে গলা নামিয়ে দোকানিকে বললেন, ফাইটিং প্লেন কেউ কখনো লোহা দিয়ে বানায়? অ্যালুমিনিয়াম, ক্যাডমিয়াম আর টাংস্টেন, জিনিসটা হালকা করতে হবে না? সেন্টার অব গ্র্যাভিটি যদি ঠিক না থাকে জিনিসটার ব্যালেন্স হবে কী ভাবে?
দোকানি কিছু না বুঝে একটু অপ্রস্তুতের মতো হাসল। সফদর আলী আরো কী বলতে চাইছিলেন, আমি কোনোমতে তাঁকে টেনে সরিয়ে আনি। সদরঘাটের ভিড় বাঁচিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সফদর আলী কী যেন চিন্তা করতে থাকেন, আমি তাকে বিরক্ত করলাম না। খানিকক্ষণ কোনো কথাবার্তা নেই, হঠাৎ একসময় ঘুরে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, মানুষের ডিজাইনটা আসলে ঠিক হয় নি।
আমি কিছু না বুঝে বললাম, কি বললেন?
মানুষের ডিজাইন, খুবই দায়সারা ডিজাইন।
মানে?
যেমন ধরেন এই হাতের ব্যাপারটা, মোটে দুইটা হাতে কি কিছু হয়? একটা মানুষের অন্তত চারটা হাত থাকা উচিত ছিল।
চারটা হাত?
হ্যাঁ। দুইটা হাতে কিছুই হয় না।
আমি একটু ইতস্তত করে বললাম, চারটা হাতের কী দরকার? আমার তো দুইটা হাতেই বেশ চলে যাচ্ছে। ছেলেবেলায় একবার নাটক করতে স্টেজে উঠেছিলাম–বিবেকের পার্ট, তখন দুই হাত নিয়েই কী মুশকিল, কোথায় নিয়ে লুকাই, কী করি! চার হাত হলে যে কী সর্বনাশ হত।
বাচ্চা ছেলেদের কথা শুনে বড়রা যেভাবে হাসে, সফদর আলী সেভাবে একটু হেসে বললেন, কী যে আপনি বলেন! কখনো সল্ডারিং করেছেন?
না।
করলে বুঝবেন। সন্ডার করার সময় এক হাতে জিনিসটা ধরতে হয়, আরেক হাতে সল্ডারিং আয়রন। ব্যস, দুই হাতই শেষ, সন্ডার ধরবেন কী দিয়ে? যদি চারটা হাত থাকত তা হলে তিন নম্বর হাত দিয়ে সল্ডার ধরা যেত।
কিন্তু আপনি তো চারটা হাতের কথা বলছেন।
হ্যাঁ, চার নম্বর হাত হচ্ছে চুলকানোর জন্যে। লক্ষ করে দেখেছেন, যখন কোনো কাজে দুই হাতই ব্যস্ত থাকে তখন সবসময় নাকের ডগা চুলকাতে থাকে?
আমাকে স্বীকার করতেই হল যে ব্যাপারটি সত্যি এবং চুলকানোর জন্যে একটা বাড়তি হাত থাকা আসলে মন্দ ব্যবস্থা নয়।
সফদর আলী তাঁর ব্যান্ডেজ বাঁধা বুড়ো আঙুলটি দেখিয়ে বললেন, যদি আমার চারটা হাত থাকত, তাহলে আমি তিন নম্বর হাত দিয়ে কিকুলমুকাসের ডালাটা ধরে রাখতে পারতাম। যখন মশাটা এসে কামড় দিল তখন চার নম্বর হাত দিয়ে কষে দিতে পারতাম একটা থাবড়া।
সফদর আলী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, মশার জন্যে, না চার নম্বর হাত নেই সেই দুঃখে ঠিক বুঝতে পারলাম না।
আমি চার হাতের একটা মানুষ কল্পনা করার চেষ্টা করলাম, কিন্তু ব্যাপারটা খুব সহজ হল না, খানিকক্ষণ চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিয়ে সফদর আলীকে জিজ্ঞেস করলাম, বাকি দুটো হাত থাকবে কোথায় সফদর সাহেব?