বগুড়া থেকে ফিরে আসতে বেশ দেরি হল। যাবার আগে ঠিকানা দিয়ে গিয়েছিলাম, ভেবেছিলাম একটি দুটি টেলিগ্রাম হয়তো পাব, কিন্তু কোথায় কি, কোনো খোঁজখবরই নেই। ফিরে এসেই সফদর আলীর বাসায় গেলাম। দরজায় ধাক্কা দিতেই যথারীতি কুকুরের ডাক, কিন্তু তারপর কোনো সাড়াশব্দ নেই। আমি ঘরের দরজায় একটা চিঠি। লিখে এলাম যে পরদিন বিকেলবেলা অফিস ফেরত আসব, সফদর আলী যেন বাসায় থাকেন।
পরদিন সফদর আলীর বাসায় গিয়ে দেখি, দরজায় লাগানো চিঠিটা নেই, যার অর্থ তিনি চিঠিটা পেয়েছেন। আমি দরজায় ধাক্কা দিতেই কুকুরের বদরাগী ডাকাকার্কি শুরু হয়ে গেল, কিন্তু তার বেশি কিছু নয়। সফদর আলী আমার চিঠি পেয়েও বাসাতে নেই—ভারি আশ্চর্য ব্যাপার! দরজায় বার কয়েক শব্দ করার পর মনে হল একটা জানালা দিয়ে কেউ একজন আমাকে উঁকি মেরে দেখে জানালাটা বন্ধ করে দিল। জংবাহাদুর হতে পারে না, কিন্তু সফদর আলী এরকম করবেন কেন?
আমি পরপর আরো কয়েকদিন চেষ্টা করি, কিন্তু কিছুতেই সফদর আলীকে ধরতে পারলাম না। নিঃসন্দেহে তিনি পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। কিন্তু কেন? আমার কাছ থেকে পালিয়ে বেড়ানোর প্রয়োজন কি? আমি মহা ধাঁধায় পড়ে গেলাম।
সপ্তাহ দুয়েক পর সফদর আলীকে আমি কাওরান বাজারে সেই রেস্তরাঁয় আবিষ্কার করলাম, আমাকে দেখে আবার পালিয়ে না যান সেজন্যে শব্দ না করে একেবারে তাঁর কাছে গিয়ে ডাকলাম, এই যে সফদর সাহেব।
সফদর আলী চা খাচ্ছিলেন। হঠাৎ চমকে উঠে গরম চা দিয়ে তিনি মুখ পুড়িয়ে ফেলেন। আমাকে দেখে তাঁর চেহারা কেমন ফ্যাকাসে হয়ে গেল। অনেক কষ্টে তোতলাতে তোতলাতে বললেন, কী খবর ইকবাল সাহেব?
আমার আবার কিসের খবর, খবর তো সব আপনার কাছে। আপনার তো দেখাই পাওয়া যায় না। কয়েক দিন আপনার বাসায় গিয়েছিলাম, চিঠি রেখে এসেছিলাম।
ও আচ্ছা, তাই নাকি, এই ধরনের কথাবার্তা বলে তিনি ব্যাপারটা এড়িয়ে গিয়ে সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিকভাবে বললেন, কেমন গরম পড়ে যাচ্ছে দেখেছেন?
আসলে তেমন কিছু গরম নয়, শুধু কথা বলার জন্যে কথা বলা, আমি সোজাসুজি আসল কথায় চলে আসি, মোরগের বাচ্চাগুলোর খবর কি?
সফদর আলী না শোনার ভান করে বললেন, নতুন ম্যানেজার এসেছে রেস্তরাঁয়, খুব কড়া, চায়ের কাপগুলো কি পরিষ্কার দেখেছেন?
আমি আরেকবার চেষ্টা করলাম, মোরগের বাচ্চাগুলোর কী খবর, কেমন আছে সেগুলো? কত বড় হয়েছে?
আছে একরকম, বলে সফদর সাহেব কথা ঘোরানোর চেষ্টা করলেন। বললেন, টিভি দেখে দেখে জংবাহাদুরের চোখ খারাপ হয়ে গেছে, চশমা নিতে হয়েছে।
বানরের টিভি দেখে চোখ খারাপ হওয়ায় চশমা নিতে হয়েছে, খবরটা নিঃসন্দেহে চমকপ্রদ। কিন্তু মোরগের বাচ্চার খবর জানতে চাইলে সেটা না দিয়ে এই খবর দেওয়ার জন্যে ব্যস্ত কেন? আমি হাল ছেড়ে না দিয়ে আরো একবার চেষ্টা করলাম, বললাম, সফদর সাহেব, আপনি কথা ঘোরানোর চেষ্টা করছেন কেন? মোরগের বাচ্চাগুলো ভালো আছে তো?
সফদর আলী পরিষ্কার আমার কথা না শোনার ভান করে বললেন, ভীষণ চোরের উপদ্রব হয়েছে আজকাল, পাশের বাসা থেকে সবকিছু চুরি হয়ে গেছে।
আমি হাঁ করে তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকি। তিনি যদি বলতে না চান আমি তো আর জোর করে বলতে পারি না। তাঁর আবিষ্কার, তাঁর পরিশ্রম, আমি কোথাকার কে? কিন্তু কী হয়েছে বলতে এত আপত্তি কেন, আমি তো আর তাঁকে খেয়ে ফেলতাম না। ভারি অবাক কাণ্ড!
সফদর আলী আগের কথার জের টেনে বললেন, চোরটা ভারি পাজি। চুরি করে যা কিছু নিতে পারে নেয়, বাকি সব নষ্ট করে দিয়ে যায়। সেদিন একজনের রান্না করা খাবারে পুরো বাটি লবণ ঢেলে দিয়ে গেছে।
আমি কিছু না বলে চুপ করে থাকি। সফদর আলী বলতে থাকেন, আগের সপ্তাহে এক বাসা থেকে অনেককিছু ছুরি করে নিয়ে গেছে। যাবার আগে ছোট মেয়েটার পুতুলের মাথাটা ভেঙে দিয়ে গেছে, ভারি পাজি চোর!
আমি সফদর আলীর মুখের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে ভাবলাম, না জানি কি হয়েছে মোরগগুলোর। আমাকে জোর করে চোরের গল্প শোনাচ্ছেন কেন?
সফদর আলী চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন, চোর ধরার একটা যন্ত্র বানাচ্ছি এখন, খুব কায়দার জিনিস হবে। একটা এস. এল. আর. ক্যামেরা জুম লেন্সসহ আছে, আগে ছবি তুলে ফেলবে। চোর ব্যাটা যদি পালিয়েও যায়, তার ছবি তোলা হয়ে যাবে।
সফদর আলী একাই অনেক কথা বলে গেলেন। আমার কথা বলার উৎসাহ নেই। প্রথমে তাঁর ব্যবহারে বেশ দুঃখই লেগেছিল, কিন্তু তাঁকে বেশ অনেকদিন থেকে চিনি। তাই দুঃখটা স্থায়ী হল না। ব্যাপারটা চিন্তা করে আস্তে আস্তে আমি ভারি অবাক হয়ে যাই, পুরো জিনিসটা একটা রহস্যময় ধাঁধার মতো। এই এক মাসে মোরগের বাচ্চাগুলোর কি হতে পারে, যা তিনি আমাকে বলতে চান না? আমার কথা না শুনে মোরগের বাচ্চাগুলোর উপর নিশ্চয়ই কিছু একটা গবেষণা করে পুরো ব্যাপারটি ঘোল পাকিয়েছেন। এখন আমাকে আর সেটা বলতে চাইছেন না। ছোটখাট নয়, বড় ধরনের কিছু। কিন্তু কী হতে পারে? আমাকে বলতে এত আপত্তি কেন?
এভাবে আরো সপ্তাহখানেক কেটে গেল। সফদর আলীর সাথে আজকাল দেখা হয় খুব কম, মোরগের বাচ্চার ব্যাপারটি এভাবে আমার কাছ থেকে গোপন করার পর আমিও নিজেকে একটু গুটিয়ে ফেলেছি। অনেক চেষ্টা করেও জানতে না পেরে আজকাল ব্যাপারটা ভুলে যাবার চেষ্টা করছিলাম। সেদিন অফিস ফেরত বাসায় যাবার সময় চায়ের দোকানে উঁকি মেরে দেখি সফদর আলী বসে আছেন। মুখ অত্যন্ত বিমর্ষ, আমাকে দেখে তাঁর চেহারা আরো কেমন জানি কালো হয়ে গেল। শুকনো গলায় বললেন, কী খবর ইকবাল সাহেব?