পরের বাইশ দিন আমার খুব উত্তেজনায় কাটে। ইনকিউবেটর কেমন কাজ করছে, সত্যি সত্যি ডিম ফুটে বাচ্চা বের হবে কি না এসব নিয়ে কৌতূহল। সফদর আলীর কিন্তু কোনোরকম উত্তেজনা নেই। তিনি জানেন এটা কাজ করবে। বিজ্ঞানী মানুষ, আগে অনেককিছু তৈরি করেছেন, কোনটা কাজ করবে, কোনটা করবে না কী ভাবে জানি আগেই বুঝে ফেলেন। বাইশ দিন পার হওয়ার আগেই ডিম ফুটে বাচ্চা বের হতে শুরু করে। সে যে কী অপূর্ব দৃশ্য, না দেখলে বিশ্বাস হয় না। তুলতুলে হলুদ রঙের কোমল গা। কিচকিচ করে ডেকে হৈচৈ শুরু করে দিল। আমি, সফদর আলী আর জংবাহাদুর মহা উৎসাহে বাচ্চাগুলোকে ইনকিউবেটর থেকে বের করে আনতে থাকি। সফদর আলী ওদের রাখার জন্যে ট্রে তৈরি করে রেখেছিলেন। তার উপরে নামিয়ে রেখে সেগুলো উষ্ণ একটা ঘরে রাখা হল। বাচ্চাগুলোকে খাওয়ানোর জন্যে বিশেষ ধরনের খাবার তৈরি করে রাখা হয়েছিল, তার মধ্যে নাকি নানারকম ভাইটামিন আর ওষুধ দেয়া আছে। মোরগের অসুখবিসুখ যেন না হয় সেজন্যে এই ব্যবস্থা।
পরদিন সকালের ভেতর পাঁচ শ’ তিনটা মোরগছানা কিচকিচ করে ডাকতে থাকে। ছোট ছোট হলুদ রেশমী বলের মতো বাচ্চাগুলো দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়। নয়টা ডিম নষ্ট হয়েছে, সফদর আলী সেগুলো পরীক্ষা করে দেখবেন বলে আলাদা করে রেখেছেন। পাঁচ শ মুরগির ছানাকে বড় করার দায়িত্ব খুব সহজ ব্যাপার নয়। সফদর আলী বুদ্ধি করে আগে থেকে ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন বলে রক্ষা। জংবাহাদুর এমনিতেই অলস প্রকৃতির। কিন্তু মোরগের বাচ্চাগুলো দেখাশোনায় তার খুব উৎসাহ। কেউ আশেপাশে না থাকলে সে বাচ্চাগুলোকে হাতে পায়ে ঘাড়ে নিয়ে খেলা করতে থাকে। বাচ্চাগুলোও এই কয়দিনে জংবাহাদুরকে বেশ চিনে গেছে। দেখলেই কিচকিচ করে এগিয়ে এসে ঘিরে ধরে।
এই ইনকিউবেটরটাকে কী ভাবে সাধারণ মানুষের ব্যবহারের জন্যে বাজারে ছাড়ার ব্যবস্থা করা যায় সে ব্যাপারে সফদর আলীর সাথে কথা বলতে চাইছিলাম। কিন্তু সফদর আলী এখন সেটা করতে রাজি না। তিনি বাচ্চাগুলোকে আগে বড় করতে চান। মোরগের বাচ্চাকে তাড়াতাড়ি বড় করার তাঁর কিছু ওষুধপত্র আছে। সেগুলো দিয়ে তাদের বড় করে তুলে যখন ডিম পাড়া শুরু করবে, তখন সেই ডিম দিয়ে আবার বাচ্চা ফোটাতে চান। খুব অল্প জায়গায় কী ভাবে অনেক মোরগকে রাখা যায় সে ব্যাপারেও তিনি একটু গবেষণা করতে চান। সবকিছু শেষ করে পুরো পদ্ধতিটা ইনকিউবেটরের সাথে তার বিলি করার ইচ্ছা।
ভেবে দেখলাম তাঁর পরিকল্পনাটা খারাপ নয়। শুধু ইনকিউবেটরে ডিম ফোটালেই তো হয় না, সেগুলো আবার বড়ও করতে হয়। সেটি ডিম ফোটানো থেকে এমন কিছু সহজ ব্যাপার নয়।
পরের কয়েক সপ্তাহ আমার সফদর আলীর সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতে হল। তার প্রয়োজন ছিল। কারণ একা একা কাজ করলেই তিনি তাঁর আবিষ্কারে কঠিন কঠিন জিনিস আমদানি করে ফেলেন। এই এক মাসে আমি তাঁকে যেসব জিনিস করা থেকে বন্ধ করেছি সেগুলো হচ্ছে :
(এক) মোরগের বাচ্চাগুলোর খাবার খুঁটে খেতে যেন অসুবিধে না হয় সেজন্যে তাদের ঠোঁটে স্টেনলেস স্টিলের খাপ পরিয়ে দেয়া।
(দুই) মোরগের বাচ্চাগুলোর অবসর বিনোদনের জন্যে ঘরের দেয়ালে মোরগের উপরে চলচ্চিত্র দেখানো।
(তিন) মোরগের বাচ্চাগুলো নিজেদের মধ্যে ঝগড়াঝাটি করছে কি না লক্ষ রাখার জন্যে ঘরে একটা টেলিভিশন ক্যামেরা বসিয়ে দেয়া।
(চার) শীতের সময় মোরগের বাচ্চার যেন ঠাণ্ডা লেগে না যায় সেজন্যে তাদের ছোট ছোট সোয়েটার বুনে দেয়া।
(পাঁচ) যেহেতু তারা মা ছাড়া বড় হচ্ছে, সেজন্যে নিজেদের ভাষা যেন ভুলে না যায় তার ব্যবস্থা করার জন্যে টেপরেকর্ডারে মোরগের ডাক শোনানো।
(ছয়) বাচ্চাগুলো ঠিকভাবে বড় হচ্ছে কি না দেখার জন্যে প্রত্যেক দিন তাদের ওজন করে গ্রাফ কাগজে ছকে ফেলা।
আমি কোনোভাবে নিঃশ্বাস চেপে আছি। আর দু’মাস কাটিয়ে দিতে পারলেই বাচ্চাগুলো বেশ বড়সড় হয়ে উঠবে। সফদর আলীর নতুন কিছু করার উৎসাহ বা প্রয়োজনও কমে যাবে। বাচ্চাগুলো বেশ তাড়াতাড়ি বড় হচ্ছে। কোনো অসুখ-বিসুখ নেই। সব মিলিয়ে বলা যায়, পুরো জিনিসটাই একটা বড় ধরনের সাফল্য। আমি আমার সাংবাদিক বন্ধুর সাথে কথা বলে রেখেছি, জিনিসটাকে একটু প্রচার করে তারপর সাধারণ মানুষের ব্যবহারের জন্যে ছেড়ে দিতে হবে। একটা ছোট ওয়ার্কশপে সপ্তাহে একটা করে ইনকিউবেটর তৈরি করতে পারলেই যথেষ্ট, ব্যবসা তো আর করতে যাচ্ছি। না।
ঠিক এই সময়ে আমার হঠাৎ বগুড়া যেতে হল। আমি কিছুতেই যেতে চাইছিলাম না, কিন্তু বড় সাহেব আমাকে জোর করে পাঠিয়ে দিলেন। সেখানকার হিসেবপত্রে কি নাকি গরমিল দেখা গিয়েছে। আমাকে গিয়ে সেটা ধরতে হবে। আমি যখন আপত্তি করছিলাম, তখন বড় সাহেব কথা প্রসঙ্গে বলেই ফেললেন যে তিনি আমাকে খুব বিশ্বাস করেন। তা ছাড়া অন্য সবাই দায়িত্বশীল সাংসারিক মানুষ। আমার মতো নিষ্কর্মা আর কয়জন আছে যে ঘর-সংসার ফেলে জায়গায়-অজায়গায় দৌড়াদৌড়ি করতে পারে।
যাবার আগে সফদর আলীকে বারবার করে বলে গেলাম তিনি যেন এখন মোরগের বাচ্চাগুলোর ওপর নতুন কোনো গবেষণা শুরু না করেন। বাচ্চাগুলো চমৎকার বড় হচ্ছে, তাদের ঠিক এভারে বড় হতে দেয়াই সবচেয়ে বুদ্ধির কাজ, আর কিছুই করা উচিত না, তার যত বড় বৈজ্ঞানিক আইডিয়াই আসুক না কেন।