সফদর আলী তাঁর খাতা খুলে দেখালেন। যেটাকে একটা আধুনিক কবিতা ভেবেছিলাম, সেটা আসলে মোরগের মাথা নাড়ানোর হিসেব। আমার স্বস্তির নিঃশ্বাস পড়ে। সফদর আলী এখন কবিতা লেখা শুরু করলে ভারি দুঃখের ব্যাপার হত।
খানিকক্ষণ কথাবার্তা বলে আমি তাঁর মুরগির ফার্ম এবং ইনকিউবেটরের কথা জানতে চাইলাম। সফদর আলী খুব উৎসাহ নিয়ে একটা বড় খাতা টেনে বের করে আনেন। অল্প একটা জায়গায় অনেক মুরগি বড় করার পরিকল্পনা, ইনকিউবেটরে ডিম ফোটানো হবে। ইনকিউবেটর জিনিসটা নাকি খুব সহজ, বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ ঠিক রেখে তাপমাত্রা বাইশ দিন ১০২ ডিগ্রি ফারেনহাইট করে রাখতে হয়। সফদর আলী তেজস্ক্রিয় মৌলিক পদার্থ ব্যবহারের কথা ভাবছেন, তাহলে তাপমাত্রা ঠিক রাখা নাকি পানির মতো সোজা। তাঁর একটিমাত্র সমস্যা, সেটি হচ্ছে তেজস্ক্রিয় রশ্মি। মোরগের বাচ্চার কী ক্ষতি করবে সেটা ঠিক জানেন না। ডিমগুলোকে দিনে দু’বার করে ঘুরিয়ে দেয়া এবং জলীয় বাষ্পের পরিমাণ ঠিক রাখার জন্যে একটা ছোট কম্পিউটার থাকবে। হঠাৎ করে বিদ্যুৎ চলে গেলে ইনকিউবেটর যেন বন্ধ না হয়ে যায়, সেজন্যে একটি ডায়নামোও নাকি বসানো হবে।
আমি সফদর আলীকে থামালাম। বললাম, ইনকিউবেটর তৈরি করে ডিম ফুটিয়ে মোরগের ফার্ম তৈরি করবেন খুব ভালো কথা, কিন্তু সেটা চালানোর জন্যে যদি তেজস্ক্রিয় মৌলিক বা কম্পিউটার লাগে, তাহলে লাভ কী হল? ওসব চলবে না।
কেন চলবে না? সফদর আলী উত্তেজিত হয়ে বললেন, জিনিসটা কত সহজ হয়। জানেন? একবার সুইচ অন করে ভুলে যেতে পারবেন।
ভুলে যাওয়ার দরকারটা কী? আমাদের দেশে মানুষের কি অভাব? আমি সফদর আলীকে বোঝানোর চেষ্টা করি, এমনভাবে ইনকিউবেটরটা তৈরি হবে, যেন জিনিসটা হয় সহজ, দাম হয় খুবই কম। ডিম উল্টেপাল্টে দেয়ার জন্যে কম্পিউটার লাগবে কেন? এক জন মানুষ খুব সহজেই দিনে দুইবার করে উল্টে দিতে পারবে। আপনাকে তৈরি করতে হবে জিনিসটার সত্যিকার ব্যবহার মনে রেখে।
সফদর আলী কী একটা বলতে গিয়ে থেমে যান, খানিকক্ষণ গম্ভীর মুখে চিন্তা করে বললেন, আপনি ঠিকই বলেছেন। জিনিসটা তৈরি করতে হবে সাধারণ জিনিস দিয়ে সাধারণ মানুষের জন্যে।
হ্যাঁ, সম্ভব হলে যেন ইলেকট্রিসিটি ছাড়াই চালানো যায়, গ্যাস কিংবা কেরোসিন দিয়ে।
সফদর আলীর মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। একগাল হেসে বললেন, তাহলে তো জিনিসটা তৈরি করা খুবই সহজ। একদিনে বানাতে পারব। ভাবছিলাম ফাইবার গ্লাস দিয়ে বানাব। কিন্তু তার দরকার নেই। কেরোসিন কাঠ দিয়ে পুরো জিনিসটা তৈরি হবে। দু’ প্রস্থ কাঠের মাঝখানে থাকবে তুসি। তাহলে তাপটা বেরিয়ে যাবে না। গ্যাসের চুলা দিয়ে বাতাসটা গরম করা হবে। বাতাসটা ভেতরে ছড়িয়ে যাবে তাপমাত্রা বাড়ানোর জন্যে। মাঝে মাঝে ছোট ছোট গামলায় পানি রাখা হবে। পানি বাষ্পীভূত হয়ে নিজে থেকেই জলীয় বাষ্পের পরিমাণ ঠিক রাখবে, যে জিনিসটা একটু কঠিন সেটা হচ্ছে তাপমাত্রা ঠিক রাখা। একটা ছোট ফিডবাক সার্কিট তৈরি করতে হবে সেজন্যে, সস্তা অপ এম্প দিয়ে বানাব। খরচ পড়বে খুবই কম। ইনকিউবেটরের ভিতরের তাপমাত্রাটা দেখে বাতাসের প্রবাহটাকে বাড়িয়ে না হয় কমিয়ে দেবে। চালানোর জন্যে লাগবে মাত্র দুটো ৯ ভোন্টের ব্যাটারি। কাঠের ট্রেতে ভুষির উপরে থাকবে ডিম, ডিমের কেস তৈরি করার কোনো প্রয়োজন নেই। একসাথে এক হাজার ডিম ফোটানো যাবে।
ফিডব্যাক সার্কিটের ব্যাপারটা ছাড়া পুরো জিনিসটা আমি বুঝতে পারলাম। সত্যিই যদি এত সহজে বানানো যায়, তাহলে তো কথাই নেই। সফদর আলীর উপর আমার বিশ্বাস আছে, তিনি ঠিক ইনকিউরেটর তৈরি করে দেবেন, যেটা একমাত্র সমস্যা সেটা হচ্ছে, সুযোগ পেলেই তিনি তাঁর আবিষ্কারে কঠিন কঠিন জিনিস জুড়ে দিতে চান। কী একটা হয়েছে আজকাল, কম্পিউটার ছাড়া কথা বলতে চান না।
ইনকিউবেটর নিয়ে আলোচনা করতে করতে সফদর আলী বেশ উত্তেজিত হয়ে ওঠেন। কাগজ বের করে তখন-তখনি জিনিসটা আঁকতে শুরু করেন। আমি একটু ইতস্তত করে বললাম, শুরু করার আগে একটু চা খেলে কেমন হয়?
সফদর আলী বললেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। তারপর জংবাহাদুরের দিকে তাকিয়ে হুঁঙ্কার দিয়ে বললেন, জংবাহাদুর, চা বানাও।
জংবাহাদুর একবার আমার দিকে, একবার সফদর আলীর দিকে বিষদৃষ্টিতে তাকিয়ে চা বানাতে উঠে গেল।
সপ্তাহখানেক খেটেখুটে সফদর আলী তাঁর ইনকিউবেটর তৈরি করলেন। জিনিসটা দেখতে একটা পুরানো সিন্দুকের মতো। কিন্তু সফদর আলীর কোনো সন্দেহ নেই যে এটা কাজ করবে। ইকিউবেটরটা পরীক্ষা করে দেখার জন্যে সফদর আলী একদিন ডিম কিনতে গেলেন। ভাবলাম হয়তো গোটা দশেক ডিম কিনে আনবেন, যদি নষ্ট হয় তাহলে এই দশটা ডিমের উপর দিয়েই যাবে। কিন্তু সফদর আলী সেরকম মানুষই নন, ইনকিউবেটরের উপর তাঁর এত বিশ্বাস যে, বাজার ঘুরে ঘুরে তিনি পাঁচ শ’ চৌদ্দটা ডিম কিনে আনলেন। পাঁচ শ’ বারটা যাবে ইনকিউবেটরের ভেতরে। দুটি সকালের নাস্তা করার জন্যে।
সেদিন বিকেলেই ডিমগুলো ইনকিউবেটরে ঢোকানো হল। ব্যাপারটি দেখার জন্যে আমি অফিস ফেরত সকাল সকাল চলে এলাম। পেন্সিল দিয়ে সফদর আলী সবগুলোর উপর একটি করে সংখ্যা লিখে দিলেন। এতে ডিমগুলোর হিসেব রাখাও সুবিধে, আবার উল্টে দিতেও সুবিধে। সংখ্যাটি তখন নিচে চলে যাবে। ডিমগুলো সাজিয়ে রেখে ইনকিউবেটরের ঢাকনা বন্ধ করে সফদর আলী গ্যাসের চুলা জ্বালিয়ে দিলেন। শোঁ শোঁ করে চুলা জ্বলতে থাকে। দেখতে দেখতে তাপমাত্রা বেড়ে ১০২ পর্যন্ত উঠে সেখানে স্থির হয়ে যায়। এখন এইভাবে বাইশ দিন যেতে হবে। তা হলে ডিম থেকে বাচ্চা ফুটে বের হবে।