আমি মাথা চুলকে বললাম, শুনেছি মানে তো নয় বুঝেছি। শোনা আর বোঝা কি এক জিনিস?
তার মানে আপনি কিছু বোঝেন নি? ডিটেলস বুঝি নি, কিন্তু মোটামুটি আইডিয়াটা পেয়েছি।
সফদর আলী পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে টেবিলে খুলে ধরেন। ভয়ানক জটিল একটা সার্কিট। তার মাঝে এক জায়গায় একটা আঙুল ধরে বললেন, এখান থেকে শুরু করি। আপনি তাহলে বুঝবেন। এই যে দেখছেন—
আমি তাঁকে থামালাম। বললাম, সফদর সাহেব, আমি এসব ভালো বুঝি না, খামোকা আপনার সময় নষ্ট হবে। এর থেকে অন্য একটা জিনিস আলোচনা করা যাক।
কী জিনিস?
এই মাকড়সাটা তৈরি করার প্রয়োজনটা কি?
সফদর আলী খানিকক্ষণ হাঁ করে তাকিয়ে থাকলেন, তারপর আস্তে আস্তে বললেন, আমি ভাবলাম মাকড়সারা কী করে সেটা অন্তত বুঝেছেন। যখন কোনো জায়গায় চুলকাতে থাকে—
হ্যাঁ হ্যাঁ, তা বুঝেছি। কিন্তু সেটা কি এতই জরুরি জিনিস?
জরুরি নয়? আমি যখন কাজ করি তখন দুটো হাতের দরকার, তার মাঝে যদি কোনো জায়গা চুলকাতে থাকে আমি কী করব?
ঠিক আছে মানলাম, এরা যথেষ্ট জরুরি। কিন্তু এর থেকে জরুরি কোনো জিনিস নেই?
কী আছে? এর থেকে জরুরি কী হতে পারে।
আপনার কাছেই জরুরি হতে হবে সেটা ঠিক নয়। অন্য দশজন মানুষের জন্যে জরুরি হতে পারে। আপনার এরকম প্রতিভা, সেটা যদি সত্যিকার কাজে লাগান, কত উপকার হত।
কি রকম কাজ?
আমি একটু ইতস্তত করে বললাম, গরিব দেশ আমাদের, লোকজন খেতে-পরতে পারে না। যদি গবেষণা করে বের করতেন খাওয়ার সমস্যা কী ভাবে মেটানো যায়, বিশেষ ধরনের ধান, যেখানে চাল বেশি হয় বা বিশেষ ধরনের মাছ, যেটা তাড়াতাড়ি বড় করা যায় আবার খেতেও ভালো। কিংবা গরু-বাছুর বাড়ানোর সহজ উপায়। দুধের এত অভাব! দেশে সব গরিব বাচ্চারা রোগা রোগা, তাদের জন্যে যদি কিছু করতেন। কিংবা সস্তা কাপড় যদি তৈরি করতে পারতেন, সবাই যদি ভদ্র কাপড় পরতে পারত—
সফদর আলী কী একটা বলতে গিয়ে থেমে গেলেন। খানিকক্ষণ অন্যমনস্কভাবে বসে থেকে চিন্তিতভাবে নিজের গোঁফ টানতে থাকেন। আমি একটু কথা বলার চেষ্টা করলাম, তিনি হাঁ হাঁ করে উত্তর দিচ্ছিলেন। কিন্তু আলাপে যোগ দিলেন না। আমার তাঁর জন্যে একটু খারাপই লাগে। বেচারা বিজ্ঞানী মানুষ। একটা আশ্চর্য জগতে বাস করেন। সত্যিকার মানুষের জীবন দেখেও দেখেন না, চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়ে তাঁকে নিশ্চয়ই খুব বিব্রত করে দিয়েছি। কিন্তু তাঁর যেরকম প্রতি—যদি সত্যি সাধারণ মানুষের জন্যে মাথা খাটিয়ে কিছু একটা বের করেন, খারাপ কী?
পরের সপ্তাহে একটা টেলিগ্রাম পেলাম। টেলিগ্রামে লেখা :
আপনি ঠিক। মাকড়সা চুরমার। খাদ্য গবেষণা।
বিষয়বস্তু পরিষ্কার, আমার কথা ঠিক, তাই তিনি তাঁর মাকড়সাকে চুরমার করে খাদ্যের উপর গবেষণা শুরু করে দিয়েছেন। মাকড়সাটির জন্যে আমার একটু দুঃখ হয়, চুলকানোর এরকম যন্ত্র চুরমার করে ফেলার কি প্রয়োজন ছিল?
পরের সপ্তাহে আরেকট। টেলিগ্রাম পেলাম, তাতে লেখা :
ডিম। মুরগি। মুরগি ফার্ম। ইনকিউবেটর। কম্পিউটার কন্ট্রোল।
মানে বুঝতে মোটেই অসুবিধে হল মা। তিনি মুরগির ফার্ম তৈরি করার কথা ভাবছেন। সেখানে ইনকিউবেটর ব্যবহার করে ডিম থেকে বাচ্চা ফোটানো হবে। চমৎকার ব্যবস্থা। তবে কম্পিউটার ব্যবহার করে সেটাকে নিয়ন্ত্রণ করা হবে ব্যাপারটি আমাকে ঘাবড়ে দিল। একটি মুরগির ফার্ম চালানোর জন্যেদি কম্পিউটারের প্রয়োজন হয়, তাহলে লাভ কি? সফদর আলীর গবেষণা আমার ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাবার আগে তার সাথে দেখা করতে গেলাম। ভাগ্য ভালো আমার, সফদর আলী বাসাতেই ছিলেন, জংবাহাদুর দরজা খুলে আমাকে ভেতরে নিয়ে গেল, সফদর আলীর কাছে। পৌঁছে দিয়ে সে নিজে একটা ইজিচেয়ারে শুয়ে পড়ে। পাশের টেবিলে খাবার, সামনে টেলিভিশন চলছে, বানরের উপর একটা অনুষ্ঠান হচ্ছে। তাই জংবাহাদুরের মুখে একটা পরিষ্কার তাচ্ছিল্যের ভঙ্গি।
সফদর আলীর টেবিলের চারপাশে অনেকগুলো খাঁচা, সেখানে অনেকগুলো নানা বয়সের মোরগ-মুরগি হেঁটে বেড়াচ্ছে। সফদর আলী গম্ভীর মুখে একটা মুরগির দকে তাকিয়ে আছেন। তাঁর হাতে কাগজ-কলম, মুরগির দিকে তাকিয়ে থেকে থেকে একটু পরপর কী যেন লিখছেন। উঁকি মেরে দেখে মনে হল আধুনিক কবিতা, কারণ তাতে লেখা :
ডাম বাম ডান বাম ডান ডান বাম
বাম ডান বাম ডান বাম বাম বাম
রাম রাম ভান রাম রাম ডান বাম
সফদর আলী খাতা বন্ধ করে বললেন, মোরগের সাথে মানুষের পার্থক্য কি বলেন দেখি?
মাথা চুলকে বললাম, আমরা মোরগকে রান্না করে খাই, মোরগ আমাদের রান্না করে খায় না।
সফদর আলী, চিন্তিত মুখে বললেন, আপনাকে নিয়ে এই হচ্ছে মুশকিল, খাওয়া ছাড়া আর কিছু চিন্তা করতে পারেন না।
কথাটা খানিকটা সত্যি, আমি একটু লজ্জা পেয়ে গেলাম।
সফদর আলী বললেন, মানুষের দুটি চোখই সামনে। তাই তাদের বাইনোকুলারদৃষ্টি। কোনো জিনিসের দিকে তাকিয়ে তারা দূরত্ব বুঝতে পারে। এক চোখ বন্ধ করে সুইয়ে সুতো পরানোর চেষ্টা করে দেখবেন কত কঠিন। বোঝা যায় না সুইটা কাছে না দূরে। মোরগের দুই চোখ দুই পাশে, তাই দূরত্ব বুঝতে হলে মোরগকে ক্রমাগত মাথা নাড়তে হয়। একবার ডান চোখে জিনিসটা দেখে, একবার বাম চোখে। বেশিরভাগ পাখিও মোরগের মতো। এজন্যে পাখিরাও মাথা নাড়ে। এই দেখেন আমি লিখছিলাম মোরগ কী ভাবে তার চোখ ব্যবহার করে।