আমার তখনো বিশ্বাস হয় না। টেবিলের উপর কোনোমতে ফেলে দিই কুৎসিত মাকড়সাটাকে। সেটা ঠিক জ্যান্ত মাকড়সার মতো হেঁটে বেড়াতে থাকে। ঘেন্নায় আমার প্রায় বমি হবার মতো অবস্থা, মাকড়সা আমার ভারি খারাপ লাগে। কেউ যদি বলে একটা ঘরে একটা জ্যান্ত মাকড়সার সাথে থাকবে না একটা জ্যান্ত বাঘের সাথে থাকবে? আমি সম্ভবত বাঘের সাথেই থাকব।
সফদর আলী হাসতে হাসতে বললেন, এত ভয় পাচ্ছেন কেন? এটা ইলেকট্রনিক, দুটো মাইক্রোপ্রসেসর আছে ভেতরে। দু’মাস লেগেছে তৈরি করতে।
দু’মাস খরচ করে একটা মাকড়সা তৈরি করেছেন? আমার বিশ্বাস হয় না, সফদর আলী দু’ঘন্টায় একটা পুরো কম্পিউটার খুলে আবার জুড়ে দিতে পারেন। আমি নিজের চোখে দেখেছি।
সময় লাগবে না? এইটুকু মাকড়সার শরীরে কতকিছু ঢোকাতে হয়েছে জানেন? পাওয়ার সাপ্লাই থেকে শুরু করে লজিক গেট, মাইক্রোপ্রসেসর, র্যাম, স্টেপ মোটর, গিয়ার–
এত কষ্ট করে একটা মাকড়সা তৈরি করলেন? একটা ভালো কিছু তৈরি করতে পারতেন, প্রজাপতি বা পাখি। কে মাকড়সা দিয়ে খেলবে?
সফদর আলী একটু আঘাত পেলেন বলে মনে হল। গম্ভীর গলায় বললেন, আপনি কি ভাবছেন এটা খেলার জিনিস?
আমি একটু অপ্রস্তুত হয়ে বললাম, তাহলে কি?
কাছে আসেন, আপনাকে দেখাচ্ছি।
আমি ভয়ে ভয়ে তাঁর কাছে এগিয়ে যাই। তিনি আমার শার্টের ফাঁক দিয়ে মাকড়সাটাকে ঢুকিয়ে দিলেন। সেটা হেঁটে হেঁটে আমার পিঠের উপর এক জায়গায় গিয়ে স্থির হয়ে দাঁড়াল। যদিও জানি এটা সত্যিকার মাকড়সা নয়, নেহায়েত ইলেকট্রনিক কলকজা, তবুও আমার সারা শরীর ভয়ে কাঁটা দিয়ে উঠতে থাকে। আমি শরীর শক্ত করে দম বন্ধ করে বসে থাকি। মাকড়সাও বসে থাকে চুপ করে। বেশ খানিকক্ষণ কেটে গেল এভাবে, আমি জিজ্ঞেস করলাম, কী হল?
সফদর আলী বললেন, কিছু হচ্ছে না?
নাহ্। শরীরের কোনো জায়গা চুলকোচ্ছে না?
নাহ্।
তিনি খানিকক্ষণ মাথা চুলকে বললেন, আসলে আপনি যদি এমন একটা কাজ করতে থাকেন যে, হাত সরানোর উপায় নেই তাহলে শরীরের কঠিন কঠিন জায়গা চুলকাতে থাকে। আমি মাথা নাড়লাম, কথাটা সত্যি, কিন্তু মাকড়সার সাথে শরীর চুলকানোর কী সম্পর্ক ঠিক বুঝতে পারলাম না।
সফদর আলীর মুখ হঠাৎ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। এগিয়ে এসে বললেন, আপনার হাত দুটি দিন।
আমি হাত দুটি এগিয়ে দিতেই কিছু বোঝার আগে তিনি পকেট থেকে রুমাল বের করে হাত দুটি চেয়ারের হাতলের সাথে শক্ত করে বেঁধে ফেললেন। আমি অবাক হয়ে বললাম, কী করছেন?
এখন আপনার হাত দুটি বাঁধা। কাজেই শরীরের কোনো জায়গা চুলকালে আপনি চুলকাতে পারবেন না।
হ্যাঁ, তাতে কী হয়েছে?
কাজেই এখন আপনার শরীরের নানা জায়গা চুলকাতে থাকবে। সফদর আলী চোখ নাচিয়ে বললেন, কি, সত্যি বলেছি কি না?
কথাটা সত্যি। ছেলেবেলায় যেদিন রোজা থাকতাম, ভোরে ঘুম থেকে উঠেই মনে পড়ত আজ খাওয়া বন্ধ। সাথে সাথে খিদে লেগে যেত। এবারেও তাই হঠাৎ মনে হতে থাকে ঘাড়ের কাছে একটু একটু চুলকাচ্ছে। সত্যি তাই, চুলকানি বাড়তেই থাকে, বাড়তেই থাকে। অন্যমনস্ক হলে চুলকানি চলে যাবে ভেবে অন্যমনস্ক হবার চেষ্টা করি। কিন্তু কোথায় কি, চুলকানি বাড়তেই থাকে। সফদর আলীকে হাত দুটি খুলে দিতে বলব, এমন সময় হঠাৎ টের পাই মাকড়সাটা ঘাড়ের দিকে হাঁটতে শুরু করেছে। হেঁটে হেঁটে যেখানে চুলকাচ্ছে ঠিক সেখানে এসে চুলকে দিতে থাকে। আরামে আমার চোখ প্রায় বন্ধ হয়ে আসে। মাঝে মাঝে যখন বাগানে কাজ করে কাদায় হাত মাখামাখি হয়ে যেত, তখন পিঠে কোথাও চুলকালে ভাগনেকে বলতাম চুলকে দিতে। সে কিছুতেই ঠিক জায়গাটা বের করতে পারত না। আমি বলতাম, আরেকটু উপরে, সে বেশি উপরে চলে যেত। বলতাম, আরেকটু নিচে, সে বেশি নিচে চলে যেত। যখন জায়গাটা মোটামুটি বের করতে পারত তখন হয় বেশি জোরে না হয় বেশি আস্তে চুলকে দিত, কিছুতেই ঠিক করে চুলকাতে পারত না। এই মাকড়সাটা অপূর্ব, উপরেও। নয়, নিচেও নয়, ঠিক জায়গাটাতে ঠিকভাবে চুলকাতে থাকে। যখন ভাবলাম আরেকটু জোরে হলে ভালো হয় মাকড়সাটা ঠিক আরেকটু জোরে চুলকাতে থাকে, আশ্চর্য ব্যাপার।
সফদর আলী আমার মুখের ভাব লক্ষ করছিলেন, এবারে হাতের বাঁধন খুলে দিতে দিতে একগাল হেসে বললেন, দেখলেন তো এটা কী করতে পারে?
আমার স্বীকার করতেই হল ব্যাপারটা অসাধারণ। নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাসই করতাম না যে এটা আদৌ তৈরি করা সম্ভব।
সফদর আলী জিজ্ঞেস করলেন, কী ভাবে কাজ করে বুঝেছেন?
আমি কী ভাবে বুঝব?
একটুও বুঝতে পারেন নি? সফদর আলীর একটু আশাভঙ্গ হল বলে মনে হল। এই যে আটটা পা দেখছেন এগুলো হচ্ছে আটটা নার্ভ সেন্সর। শরীরের নার্ভ থেকে এটা কম্পন ধরতে পারে। সেটা থেকে এটা বুঝতে পারে কোথাও চুলকাচ্ছে কি না। যখন বুঝতে পারে, তখন সেটা সেন্ট্রাল সি. পি. ইউ.-তে একটা খবর পাঠায়। সাথে সাথে ফিডব্যাক সার্কিট কাজ শুরু করে দেয়—
আমি একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়ি। নিঃসন্দেহে জিনিসটা অসাধারণ। কিন্তু এত কষ্ট করে এরকম একটা জিনিস তৈরি করার সত্যি কি কোনো প্রয়োজন ছিল? সফদর আলীর এত প্রতিভা, সেটা যদি সত্যিকার কোনো কাজে লাগাতেন, যেটা দিয়ে সাধারণ মানুষের কোনোরকম উপকার হত—
কী হল? আপনি আমার কথা শুনছেন না, অন্যকিছু ভাবছেন।
না, না, শুনছি।
তাহলে বলুন তো স্টেপিং মোটরে কত মাইক্রো সেকেন্ড পরপর টি. টি, এল পালস পাঠাতে হয়?