পরদিন সফদর আলীকে চেনা যায় না, চোখ বসে গিয়েছে, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, দেখে মনে হয় এক রাতে বয়স দশ বছর বেড়ে গিয়েছে। আমার তখন খারাপ লাগতে থাকে, ভীতু মানুষ, এতটা বাড়াবাড়ি না করলেও হত।
সফদর আলী উঠেই তাঁর ভ্রমণবন্দি গোছাতে শুরু করলেন, এই হোটেলে তিনি আর থাকবেন না। ব্যাপারটা আয়ত্তের বাইরে চলে যাচ্ছে দেখে আমাকে পুরো ব্যাপারটা খুলে বলতে হল। ভাবছিলাম শুনে বুঝি সফদর আলী খুব রাগ করবেন, কিন্তু উল্টো এত খুশি হয়ে উঠলেন যে বলার নয়। ভূতটুত কিছু নয়, আমি আর মতিন মিলে তাঁকে ভয় দেখিয়েছি ব্যাপারটা তাঁর কাছে এত মজার একটা ঘটনা মনে হতে থাকে যে, আমি নিজেই অবাক হয়ে যাই। পেট চেপে ধরে তিনি দুলে দুলে হাসতে থাকেন, আর একটু পরপর বলতে থাকেন, আপনারা তো সাংঘাতিক মানুষ! হিঃ হিঃ হিঃ, আমি আরো ভাবলাম সত্যিকার ভূত, হিঃ হিঃ হিঃ! মতিন সাহেবকে দেখলে মনে হয় কত বড় অফিসার, আর সে কিনা—হিঃ হিঃ হিঃ–সফদর আলী তাঁর কথা শেষ করতে পারেন না।
ব্যাপারটা এত সহজে চুকে গেল দেখে আমার স্বস্তির নিঃশ্বাস পড়ে। সফদর আলী সহজ-সরল মানুষ বলে এত সহজভাবে নিয়েছেন, অন্য কেউ হলে চটে যেত নিঃসন্দেহে। কয়জন মানুষ নিজেকে নিয়ে ঠাট্টা-তামাশা সহ্য করতে পারে? দু’জনে হালকা মন নিয়ে বের হই। আজকেও হোটেল মালিক ইজিচেয়ারে বসে আছেন। কবুতরগুলো পায়ের কাছে বসে দানা খাচ্ছে। আমাদের বের হতে দেখে কেমন জানি বাঁকা করে তাকিয়ে না দেখার ভান করে সামনে মুখ ঘুরিয়ে নিলেন, ভদ্রলোকের হয়তো কথা বলার ইচ্ছে নেই, আমরা তাঁকে আর ঘাটালাম না।
নাস্তা করে ভাবলাম জেলেপল্লী থেকে ঘুরে আসি। জেলেনৌকা করে সফদর আলীর সমুদ্রে যাবার শখ। ব্যাপারটা আললাচনা করে আসবেন। পথে মতিনের বাসা, ভাবলাম একটু দেখা করে যাই। তাকে দেখে গত রাতে সফদর আলী কেমন ভয় পেলেন নিশ্চয়ই জানতে চাইছে। দরজায় টোকা দেয়ার আগেই দরজা খুলে গেল, দেখি মতিন প্রায় ছুটে বেরিয়ে আসছে। আমাদের দেখে থতমত খেয়ে বলল, তোরা এসেছিস? আমাকে এক্ষুনি যেতে হবে। গলা নামিয়ে বলল, খবর এসেছে আবার, আজ নাকি অনেক বড় দল। রাতে আসব তোদের ওখানে।
সফদর আলী ভূতসংক্রান্ত কী একটা বলতে চাইছিলেন, মতিন তার আগেই আমাকে টেনে এক পাশে সরিয়ে নিয়ে ফিসফিস করে বলল, কাল রাতে হঠাৎ হেড অফিস থেকে ফোন, তাই আর সফদর সাহেবকে ভয় দেখানোর জন্যে যেতে পারি নি। আজ যাব। তুই আবার অপেক্ষা করে ছিলি না তো?
আমার চোয়াল স্কুলে পড়ল, কিছু বলার আগেই মতিন বলল, এক্ষুনি যেতে হবে, গেলাম আমি।
সফদর আলী এগিয়ে এসে বললেন, কী বললেন মতিন সাহেব?
আমি দুর্বল গলায় বললাম, বলল আজ রাতে সে ভূত সেজে আসবে।
আবার?
না, আবার না, গত রাতে ব্যস্ত ছিল, তাই আসতে পারে নি।
সফদর আলীর মুখ ফ্যাকাসে হয়ে যায়, ঢোক গিলে কোনোমতে বললেন, তার মানে গত রাতে সত্যি ভূত এসেছিল। সর্বনাশ!
আমরা যখন জেলেপল্লীর দিকে যাচ্ছিলাম, হঠাৎ করে পুরো ব্যাপারটা আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে যায়। সবকিছুর মূলে রয়েছে আমাদের হোটেল মালিক আর কবুতর। যখন হেরোইন ল্যাবরেটরিতে কাজ চলে, তিনি তাঁর হোটেলের সামনে কবুতর নিয়ে বসে থাকেন, যখন দেখেন পুলিশ যাচ্ছে, তিনি তাঁর কবুতর উড়িয়ে দেন। ট্রেনিং দেয়া কবুতর উড়ে গিয়ে হাজির হয় হেরোইন ল্যাবরেটরিতে। সেখানকার লোকজন দেখেই বুঝে যায় পুলিশ আসছে, তারা সবকিছু গুটিয়ে পালিয়ে যায় নিরাপদ জায়গায়। হেরোইন ল্যাবরেটরির লোকজন যখন হোটলের মালিকের কাছে কোনো খবর পাঠাতে চায়, তারা কাগজে লিখে কবুতরের পায়ে বেঁধে উড়িয়ে দেয়। কবুতর সেটা নিয়ে আসে হোটেল মালিকের কাছে। গতকাল আমরা কবুতরের পা থেকে যেটা খুলে ফেলেছিলাম, সেটা ছিল ওদের পাঠানো কোনো জরুরি খবর। ছোট শিশিতে নিশ্চয়ই কিছু হেরোইন ছিল, বানানো জিনিসটার একটু নমুনা। কাল সেজন্যেই হোটেল মালিক আমাদের মুখে তাঁর কবুতরের গল্প শুনে এত ঘাবড়ে গিয়েছিলেন। রাতে সেজন্যেই হোটেল মালিক এসেছিল আমাদের ঘরে, তাঁর সেই হেরোইনের শিশি উদ্ধার করার জন্যে। সফদর আলীর ভূতটিপি যখন উচ্চৈস্বরে আয়াতুল কুরসী পড়তে শুরু করেছে, তিনি ভয় পেয়ে পালিয়ে গেছেন।
সফদর আলীকে পুরোটা বোঝাতে একটু সময় লাগল। তিনি ভাবলেন, আমি বলতে চাইছি হোটেল মালিকের কবুতরগুলো আসলে যান্ত্রিক কবুতর, ভেতরে যন্ত্রপাতি দিয়ে বোঝাই। হোটেল মালিক সুইচ টিপে দিয়ে কবুতরগুলো উড়িয়ে দেন, সেগুলো তখন খবর নিয়ে যায় হেরোইন ল্যাবরেটরিতে। এরকম কবুতর বানানো কঠিন বলে তিনি আপত্তি করে যাচ্ছিলেন। যখন বুঝতে পারলেন আমি বলতে চাইছি কবুতরগুলো সাধারণ দেশি কবুতর এবং এগুলো দিয়েই খবর পাঠানো হয়, সফদর আলী হঠাৎ করে সবকিছু বুঝে গেলেন। খাঁটি ডিটেকটিভদের মতো আমরা সাথে সাথে বুঝে গেলাম আমাদের কি করতে হবে, মতিন তার দলবল নিয়ে রওনা দেবার আগে আমাদের গিয়ে কবুতরগুলোকে আটকাতে হবে।
দু’জনে প্রায় ছুটতে ছুটতে হাজির হলাম হোটেলে। হোটেল মালিক অলসভাবে রাস্তার দিকে তাকিয়ে বসে আছেন, পায়ের কাছে কবুতরগুলো ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমি সহজ ভঙ্গি করে হোটেল মালিকের কাছে গিয়ে বসি, তখনো অল্প অল্প হাঁপাচ্ছি। সফদর আলী চলে গেলেন কী একটা জিনিস আনতে।