কবুতরটিকে তিনি সাবধান হাতে নেন, তখন আমার চোখে পড়ে কবুতরের একটা পায়ে কী সব জিনিস বাঁধা। সফদর সাহেব সেগুলো খুলতে খুলতে বললেন, বোকা কবুতরটা মানুষকে ভয় পায় না, যার কাছে ইচ্ছা চলে যায়। নিশ্চয়ই দুষ্ট কোনো ছেলের হাতে পড়েছিল, দেখেন পায়ে কী সব বেঁধে দিয়েছে।
দুষ্ট ছেলের কাজ! পায়ে ছেড়া কাগজ, একটা শিশি, শিশিতে সাবানের গুঁড়া না কী শক্ত করে বাঁধা! আমরা সাবধানে সবকিছু খুলে কবুতরটিকে উড়িয়ে দিই।
রাতে রেস্তরা থেকে খেয়ে আমরা সকাল সকাল ফিরে আসি। আজ রাতে সফদর আলীকে ভূতের ভয় দেখানোর কথা। আগে থেকে একটা ভৌতিক আবহাওয়া তৈরি করতে হবে। হোটেলে ঢোকার সময় হোটেল মালিকের সাথে দেখা, দেখে মনে হল ভদ্রলোক কিছু একটা নিয়ে যেন একটু দুশ্চিন্তিত, আমাদের দেখে একটু হাসির ভঙ্গি করলেন। আমি বললাম, আপনার কবুতরগুলো খুব পোষ মেনেছে, মানুষকে মোটে ভয় পায় না।
হোটেল মালিক যে একটু শঙ্কিতভাবে আমাদের দিকে তাকাল, একটু আমতা আমতা করে বলল, হ্যাঁ, একটু বেশিই পোষ মেনেছে।
আজ বিকেলে উড়ে একেবারে আমার ঘাড়ে এসে বসেছে। বিরক্ত করে নি তো আবার?
না, না বিরক্ত কীসের। সফদর আলী বললেন, আমার মনে হয় আপনার কবুতরকে একটু ট্রেনিং দেওয়া দরকার।
হোটেল মালিক ভুরু কুঁচকে বললেন, কীসের ট্রেনিং?
এই যেন অপরিচিত মানুষের কাছে না যায়। আজ বিকেলে দেখি কে যেন দুষ্টুমি করে পায়ে কী সব বেঁধে দিয়েছে।
হোটেল মালিক হঠাৎ যেন একেবারে ফ্যাকাসে হয়ে গেলেন। সফদর আলী সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, আমরা খুলে দিয়েছি, আপনার কবুতরের কিছু হয় নি। চমৎকার উড়ে গেল তখন।
আমরা ঘরে ফিরে এলাম, হোটেল মালিক পিছু পিছু এলেন। ধন্যবাদ জানাতে নিশ্চয়ই। কিছু-একটা বলবেন বলবেন করেও যেন ঠিক বলতে পারলেন না।
ঘরে ঢুকেই আমি ভূতের ভয় দেখানোর প্রস্তুতি শুরু করে দিই। নিরীহ স্বরে সফদর আলীকে বললাম, হোটেলটা বেশ বড়, কিন্তু মানুষজন কত কম দেখেছেন?
সফদর আলী বললেন, ঠিক করে পাবলিসিটি করে না। নিওন লাইট দিয়ে লিখে দিত—
বাধা দিয়ে বললাম, আপনার তাই মনে হয়? আজ বাজারে এক জনের সাথে কথা বলছিলাম, সে অন্য কথা বলল।
কি বলল?
বলল বছর দুই আগে নাকি কে এক জন আত্মহত্যা করেছিল এই হোটেলে। সেই থেকে গভীর রাতে কে নাকি হেঁটে বেড়ায়। ভরা পূর্ণিমা হলে নাকি কান্নার আওয়াজ শোনা যায়।
সফদর আলীর মুখ ফ্যাকাসে মেরে যায়, আমি হালকা গলায় বললাম, লোকজন যে কি বাজে কথা বলতে পারে। শুধু শুধু এরকম একটা চমৎকার জায়গার এরকম বাজে একটা বদনাম।
আবহাওয়াটা এর মাঝে ভৌতিক হয়ে গেছে, আমি তার মাঝে আরো একটা দাগ ছেড়ে দিলাম, বললাম, ভূতের ভয় পেলেই ভয়। আমার সেরকম ভয়টয় নেই। তবে হ্যাঁ, আমার এক মামা ভয় পেতেন কিছু বটে! অবশ্যি তার কারণও ছিল।
সফদর আলী দুর্বল গলায় বললেন, কি কারণ?
আমি অনেক দিন আগে পড়া একটা ভূতের গল্প মামার গল্প হিসেবে চালিয়ে দিলাম; ভূতের গল্প সবসময় নিজের পরিচিত মানুষের গল্প হিসেবে বলতে হয়, এ ছাড়া ঠিক কাজ করে না। ভেবেছিলাম দুটি গল্প লাগবে, দেখলাম এক গল্পেই কাজ হয়ে গেল। ঘরে লাগানো বাথরুম, সেখানে যাওয়ার সময় সফদর আলী বললেন, ইকবাল সাহেব, দরজার কাছে দাঁড়াবেন একট, আমি বাথরুম থেকে আসি।
বিছানায় শুয়ে বাতি নেভানোর পর আমি আমার দ্বিতীয় গল্পটি ফেঁদে বসি। এটাও এক ইংরেজি বইয়ে পড়েছিলাম; স্থান, কাল, পাত্র একটু বদলে আমার দূর সম্পর্কের এক চাচার নিজের জীবনের ঘটনা হিসেবে চালিয়ে দিতে হল। লাশকাটা ঘরে একটা খুন হয়ে যাওয়া মানুষের গল্প, বীভৎস ঘটনা বলতে গিয়ে আমার নিজেরই গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। সফদর আলীর কথা ছেড়েই দিলাম। মতিন যখন ভূত সেজে আসবে, তখন বাড়াবাড়ি কিছু না একটা হয়ে যায়, সেটা নিয়ে দুশ্চিন্তা হতে থাকে। দরজাটা খুলে রেখেছি, রাত একটার সময় আসার কথা, গল্পে গল্পে বেশ রাত হয়ে গেছে, আর বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে বলে মনে হয় না।
একটু তন্দ্রামতে এসেছিল, হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল, জানালাটা কেউ বাইরে থেকে খোলার চেষ্টা করছে। মতিন এসে গেছে, দরজা খোলা রাখব বলেছিলাম, নিশ্চয়ই ভুলে গেছে। আমি সফদর আলীকে জাগাব ভাবছিলাম, তার আগেই সফদর আলীর ভাঙা গলা শুনতে পেলাম, ভয়ে স্বর বেরুচ্ছে না। কোনোমতে ফিসফিস করে বললেন, ইকবাল সাহেব, কি কি যেন ঘরে ঢুকছে–
আমি বললাম, চুপ, একটা কথাও না।
মতিন জানালা দিয়ে ঘরে এসে ঢোকে। বলেছিলাম, দৃ’হাত উচু করে সাদা কাপড় দিয়ে নিজেকে ঢেকে নিতে, কিন্তু মতিন বোকার মতো একটা কাল কাপড় পরে এসেছে, হাত দুটি তো উচু করেই নি, বরং চোরের মতো আস্তে আস্তে পা ফেলে ইতিউতি করে এদিক-সেদিক তাকাতে থাকে। তাই দেখেই সফদর আলীর প্রায় হার্টফেল করার মতো অবস্থা। হাতড়ে হাতড়ে কোনোমতে ভূতটিপিটা বের করে টিপে দিলেন, সাথে সাথে উচ্চস্বরে আয়াতুল কুরসি পড়া শুরু হয়ে যায়।
মতিন বেচারা গেল ঘাবড়ে। ভীষণ চমকে ওঠে। তারপর দরজার দিকে ছুটে যায় গুলির মতো, কোনোমতে দরজা খুলে এক দৌড়!
হাসির চোটে আমার প্রায় দম বন্ধ হবার মতো অবস্থ। ঘরে আলো জ্বালিয়ে সফদর আলীর সাহস ফিরিয়ে আনি। তাঁর গলা দিয়ে শব্দ বেরুচ্ছে না, ভূতটিপিটা আঁকড়ে ধরে, দুই পা তুলে বিছানায় উবু হয়ে বসে আছেন। তিনি সে রাতে আর আলো নেভাতে দিলেন না, বিছানায় জবুথবু হয়ে বসে রইলেন।