শ্যামলী আসার অনেক আগেই আমি বাতাসে বিরিয়ানির গন্ধ পেলাম। কাছাকাছি আসতেই মানুষের হৈচৈ শোনা যেতে লাগল। আরো কাছে গিয়ে দেখি সফদর আলীর বাসার চারপাশে অনেক লোজন বসে বসে বিরিয়ানি খাচ্ছে, গন্ধ শুকেই বুঝতে পারলাম, আমার বোনের রেসিপি! লোকজন হাতে থালা-বাসন নিয়ে লাইন ধরে। সফদর আলীর বাসার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আমি কী করব বুঝতে পারছিলাম না, এর মাঝে দরজা একটু ফাঁক করে সফদর আলী বের হয়ে এলেন, হাতে এক ডেকচি গরম বিরিয়ানি। লোকজনকে বিরিয়ানি ভাগ করে দিয়ে আবার ভেতরে ঢুকে যাচ্ছিলেন, আমি তাড়াতাড়ি তাঁকে ডাকলাম। সফদর আলী ঘুরে আমাকে দেখে যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেলেন, ছুটে এসে আমার হাত ধরে বললেন, ইকবাল সাহেব, তাড়াতাড়ি আসেন! আমার সর্বনাশ হয়ে যাচ্ছে।
সফদর আলীকে চেনা যায় না, চুল উশকোখুশকো, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, চোখ ভেতরে ঢুকে গেছে। আমি বললাম, কী হয়েছে আপনার?
ভেতরে আসেন, তাহলেই দেখবেন।
আমি ভয়ে ভয়ে বললাম, আপনার কুকুরটা বেঁধে রেখেছেন তো?
কুকুর? কিসের কুকুর?
সেই যে আপনার বাসায় বেল টিপতেই ঘেউ ঘেউ করে ডেকে ওঠে!
ও! সফদর আলী দুর্বলভাবে হাসলেন, মানুষজনকে ভয় দেখানোর জন্যে কুকুরের ডাক টেপ করা আছে। বেল টিপতেই বেজে ওঠে! কুকুর পাব কোথায় আমি?
আমার আগেই বোঝা উচিত ছিল। আমি সফদর আলীর সাথে ভেতরে ঢুকলাম, ভেতরে বেশ অন্ধকার। খানিকক্ষণ লাগল অন্ধকারটা চোখে সয়ে যেতে, তারপর আমি আমার জীবনের সবচেয়ে আশ্চর্য ঘটনাটি দেখতে পেলাম। ঘরের মাঝে সারি সারি গ্যাসের চুলা, তার মাঝে বিরিয়ানি রান্না হচ্ছে, রান্না করছে শত-শত গিনিপিগ! গিনিপিগগুলো ছোটাছুটি করছে, কেউ ঠেলে ঠেলে ডেকচি নিয়ে যাচ্ছে, কেউ ঘি ঢালছে, কেউ পেঁয়াজ কাটছে, কেউ নেড়ে দিচ্ছে, কেউ চাল ঢেলে দিচ্ছে—সে এক এলাহি কাণ্ড! ঘর বিরিয়ানির গন্ধে ম ম করছে। বিস্ময়ের প্রথম ধাক্কাটি সামলে আমি। কোনোমতে এক পাশে সরে এসে গিনিপিগদের দেখতে থাকি! সফদর আলী দুর্বল। গলায় বললেন, মহা বিপদে পড়েছি।
কি বিপদ?
দেখছেন না! দিন-রাত গিনিপিগেরা শুধু বিরিয়ানি রান্না করে যাচ্ছে।
কেন? আপনি না বলেছিলেন তেতাল্লিশটা গিনিপিগ, এখানে তো মনে হয় তেতাল্লিশ শ’!
তেতাল্লিশটাই তো ছিল, কিন্তু মাঝে বাচ্চা হল সবার। আমার বাচ্চা বাড়ানোর ওষুধটা পরীক্ষা করে দেখছিলাম, তাতে অল্প সময়ে সবগুলোর নাতি-পুতি হয়ে গেছে। সব মিলিয়ে প্রায় চার শ’ গিনিপিগ।
মোটে চার শ’? দেখে তো মনে হচ্ছে লাখখানেক।
আপনাদের হিসেবে প্রায় এক হাজার, আমার হিসেব ষোলভিত্তিক, তাই আমার এক শ’ হয় দু’শ ছাপ্পান্নতে!
এই সবগুলোকে আপনি বসে-বসে রান্না শিখিয়েছেন?
মাথা খারাপ আপনার? বাচ্চাগুলো নিজে-নিজে মা-বাবাদের দেখে-দেখে শিখে গেছে। সফদর আলী মাথা চুলকে বললেন, এখন সবাই রান্না করতে জানে, আর মুশকিল হচ্ছে এরা দিন-রাত শুধু রান্নাই করে যাচ্ছে, দিনে ত্রিশ-চল্লিশ বার রান্না হচ্ছে! কী ভাবে থামাই বুঝতে পারছি না।
কেন?
একবার ডেকচি গুলো কেড়ে নিতে চেষ্টা করেছিলাম, সবাই মিলে আমাকে আক্রমণ করল। কোনোমতে পালিয়ে বেঁচেছি!
আমি গিনিপিগগুলো দেখেই বুঝতে পারলাম সমস্যাটি সহজ নয়, এতগুলো গিনিপিগকে থামানো কঠিন, সবাই যদি একটু করে খামচে দেয়, শরীরের চামড়া উঠে যাবে। আমার হঠাৎ মনে পড়ল সফদর আলী বলেছিলেন, তিনি প্রথমে একটা ঘন্টা বাজাতেন, তখন রান্না শুরু হয়ে যেত। আমি জিজ্ঞেস করলাম, সফদর সাহেব, আপনার সেই ঘন্টাটি কোথায়?
ঐ যে, তিনি আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন। আশেপাশে কয়েকটা গিনিপিগ ঘোরাঘুরি করছে, মাঝে-মাঝে একটা এসে ঘন্টা বাজিয়ে দেয়, আর নতুন রান্না শুরু হয়ে যায়!
আপনি তো বলেছিলেন ঘন্টাটা আপনি নিজে বাজাতেন?
প্রথমে তাই বাজাতাম, আমাকে দেখে-দেখে এখন নিজেরাই শিখে নিয়েছে, যখন খুশি বাজিয়ে দেয়। ইলেকট্রিক ঘন্টা, বাজানোর খুব সুবিধে!
আমি সাবধানে ঘন্টাটা তুলে নেয়ার চেষ্টা করতেই প্রায় ত্রিশটা গিনিপিগ আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল, আমি লাফিয়ে কোনোমতে সরে এলাম!
সফদর আলী ছুটে এসে বললেন, সর্বনাশ! ওদের ঘাটাবেন না, মাংস শেষ হয়ে আসছে, আপনাকে কেটে বিরিয়ানির মাঝে দিয়ে দেবে!
আমি ঢোক গিলে বললাম, ঘন্টা বাজতেই যখন রান্না শুরু হয়, তখন ঘন্টা বাজানোটা বন্ধ করলেই তো সব বন্ধ হয়ে যায়। ঘন্টাটা কোনোমতে সরিয়ে ফেললেই হয়।
সফদর আলীর মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, হাতে কিল দিয়ে বললেন, ঠিক বলেছেন। কী বোকা আমি, একবারও এই সহজ জিনিসটা মনে হয় নি। ইলেকট্রিক ঘন্টা এটা, প্লাগ টেনে খুলে ফেললেই হবে, ঘন্টাটা সরাতেও হবে না! সফদর আলী ছুটে গিয়ে প্লগটা টেনে খুলে ফেললেন।
সত্যি সত্যি কিছুক্ষণের মাঝে নতুন রান্না শুরু হওয়া বন্ধ হয়ে গেল। যেসব রান্না আগেই শুরু হয়ে গিয়েছিল গিনিপিগেরা সেগুলো শেষ করে গুটিগুটি নিজেদের ঘরে ফিরে গেল। নিশ্চয়ই সেরকম ট্রেনিং দেয়া আছে। যে কয়টি গিনিপিগ ঘন্টা বাজানো শিখে নিয়ে এই দুর্গতির সৃষ্টি করেছে শুধু তারাই ঘোরাঘুরি করতে থাকে, একটু পরে পরে এসে ঘন্টা বাজানোর চেষ্টা করে, কিন্তু প্লগ খুলে নেয়ায় আর শব্দ হয় না। একসময়ে সেগুলোও তাদের ঘরে ফিরে গেল, সফদর আলী দরজা বন্ধ করে দিয়ে মুখে হাসি নিয়ে ফিরে এলেন।