সবকিছু শুনে সফদর আলী খুব উত্তেজিত হয়ে ওঠেন। এরকম ব্যাপার তিনি আগে শোনেন নি। মতিনকে জিজ্ঞেস করলেন, ল্যাবরেটরিটা কতদূর এখান থেকে?
তিরিশ মাইলের মতো। প্রথম দশ মাইল রাস্তা আছে, জিপে যাওয়া যায়। বাকিটা হেঁটে যেতে হয়। অনেক সময় লাগে পৌঁছুতে।
তার মানে ওরা পালিয়ে যাবার জন্যে যথেষ্ট সময় পায়।
হ্যাঁ।
খবরটা নিশ্চয়ই ওয়্যারলেসে পায়।
নিশ্চয়ই, এর থেকে ভালো উপায় কি হতে পারে?
সফদর আলী চিন্তিত মুখে বললেন, ওদের কেউ যদি রাস্তার ওপর চোখ রাখে, তাহলে আপনারা যখন জিপে রওনা দেন, দেখেই তো বুঝে ফেলবে। সাথে সাথে ওয়্যারলেসে খবর পাঠিয়ে দেবে।
হ্যাঁ, আমরা তাই যখন জিপে রওনা দিই তখন চেষ্টা করি ওয়্যারলেসে কোনো কথাবার্তা, সংকেত ধরতে পারি কি না।
কী ভাবে করেন সেটা? সফদর আলী তার মনের মতো বিষয় পেয়ে প্রায় ড়ুবিয়ে দেন নিজেকে, কোন ফ্রিকোয়েন্সিতে খোঁজেন?
মতিন মাথা চুলকে বলল, সেটাই হয়েছে মুশকিল। ফ্রিকোয়েন্সি তো একটা দুটা নয়, অসংখ্য—একটা মস্ত বড় রেঞ্জ। এখানে এয়ারপোর্ট আছে, জাহাজের ফ্রিকোয়েন্সি আছে, পুলিশ আর্মির ফ্রিকোয়েন্সি আছে, আজকাল আবার স্যাটালাইট থেকে আসছে, পাবলিকের ফ্রিকোয়েন্সিতে তো হাতই দেয়া যায় না। কী ভাবে যে ঠিক ফ্রিকোয়েন্সিটা বেছে নেয়া যায়, সেটাই হচ্ছে মুশকিল।
সফদর আলী উৎসাহে আরো এগিয়ে আসেন, ঠিক যখন আপনারা রওনা দেন তখন যদি হঠাৎ করে কোনো সিগন্যাল পাঠানো হয় এই এলাকা থেকে–
মতিন মাথা নেড়ে বলল, সেটাই করতে চাচ্ছি। যদি সেই সিগন্যালটা শুনতে পাই, ধরতেও তো হবে। আমাদের কাছে ভালো যন্ত্রপাতি নেই, পাঠাতে লিখেছি হেড অফিসে, শুধু দেরি করছে।
সফদর আলীর চোখ চকচক করে ওঠে, আমার কাছে একটা আছে, রিজোলিউশন বেশি নয়, তবে–
মতিন চোখ কপালে তুলে বলল, আপনার কাছে আছে? আপনি কী করেন এটা দিয়ে?
সফদর আলী লাজুকভাবে একটু হেসে বললেন, তৈরি করেছিলাম অন্য কাজে, ভেবেছিলাম যদি সমুদ্রে যাই জেলে নৌকা করে, হঠাৎ হারিয়ে গেলে কাজে লাগবে। ফ্রিকোয়েন্সি রেঞ্জটা একটু পাল্টে নিলেই ব্যবহার করা যাবে। যদি আমি–
আমাকে পুরোপুরি ভুলে গিয়ে দু’জনে খুব উত্তেজিতভাবে কথাবার্তা বলতে থাকে, সফদর আলীর জিনিসটা কী ভাবে কাজ করে সেটাই আলোচ্য বিষয়। ফ্রিকোয়েন্সি, এফ. এম., এ. এম. মড়ুলেশান, ডিমড়ুলেশান,ট্র্যাকিং, ফিডব্যাক—এধরনের কথাবার্তা আলোচনা হতে থাকে। আমি চুপচাপ বসে বসে হাই তুলতে থাকি, দুজনের কেউই ঘুরে পর্যন্ত তাকায় না। বসে বসে আমি অধৈর্য হয়ে উঠি আর আমার রাগটা ওঠে সফদর আলীর ওপর। এখন বসে বসে এসব নিয়ে কচকচি না করলে কী হত? বসে বসে বিরক্ত হতে হতে একসময়ে আমার মাথায় দুষ্টুবুদ্ধি খেলতে শুরু করে। ঠিক করলাম সফদর আলীকে ভূতের ভয় দেখাতে হবে। বেড়াতে এসে যে ফ্রিকোয়েন্সি আর ফিডব্যাক নিয়ে কচকচ করতে থাকে, ভুতের ভয় দেখিয়েই তাকে উপযুক্ত সাজা দিতে হবে। কী ভাবে করা যায় সেটাও মনে মনে ছকে ফেললাম। ঘুমানোর আগে। একটা দুটো ভূতের গল্প করব সফদর আলীর সাথে। গোরস্থানের গোর খুড়ে মৃতদেহ বের করার একটা গল্প আছে ভয়ানক। লাশকাটা ঘরেরও ক’টা গল্প জানি। ভীষণ ভয়ের সেটা। হোটেল সম্পর্কে কিছু আজগুবি জিনিস শুনিয়ে তাকে আগে থেকে নরম করে রাখা যাবে। রাতের বেলা কাউকে রাজি করাতে হবে সাদা চাদর জড়িয়ে হাজির হতে। সফদর আলীর বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে একটা নাকিকান্না দিলেই হবে। সফদর আলীকে তাহলে আর দেখতে হবে না। ভয় পেয়ে তিনি তার ভূতটিপি টিপে টিপে কী অবস্থা করবেন চিন্তা করেই আমার হাসি পেয়ে যায়। বোধহয় সত্যি সত্যি হেসে ফেলেছিলাম। কারণ হঠাৎ দেখি সফদর আলী আর মতিন কথা বন্ধ করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। মতিন বলল, কী হল?
নাহ্, কিছু না। আমি অপ্রতিভভাবে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু হাসিটাতে মনে হল একটু কাজ হল, কারণ মতিন তার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, সর্বনাশ, অনেক রাত হয়ে গেছে, তোরা তো ঘুমাবি! সারা দিন ট্রেনে-বাসে কষ্ট করে এসেছিস।
সফদর আলী কিছু বলার আগেই আমি তার কথাটি লুফে নিলাম, উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, ঠিকই বলেছিস, শরীরটা জুত করতে পারছে না।
সফদর আলীর মনে হল এরকম জমাট বৈজ্ঞানিক আলোচনায় বাধা পড়ল বলে। একটু মনঃক্ষুন্ন হলেন, কিন্তু আপত্তি না করে তিনিও উঠে দাঁড়ালেন। মতিন বলল, চল্ পৌঁছে দিয়ে আসি তোদের। এখানে আমাকে একটা ভাঙা জিপ দিয়েছে। জিপটা যদি স্টার্ট নেয়, তোদের তাহলে হেঁটে যেতে হবে না।
জিপটা বেশ সহজেই স্টার্ট নিল, দেখে মনে হল সফদর আলী যেন একটু হতাশ হলেন। যদি স্টার্ট না নিত তিনি হুঁড খুলে জিপের যন্ত্রপাতি একটু টেপাটেপি করার সুযোগ পেতেন। রওনা দেবার আগে মতিন জিজ্ঞেস করল, কোথায় উঠেছিস তোরা?
আমি হোটেলের নাম বলতেই মতিন বলল, তাই নাকি? আমরা সন্দেহজনক মানুষদের নামের যে লিস্ট বানিয়েছি, তোদের হোটেলের মালিকের নাম আছে তাতে।
সে কী! আমি অবাক হয়ে বললাম, চমৎকার ভালো মানুষ এক জন, সে বেচারা কী দোষ করল?
কোনো দোষ করে নি, কিন্তু তবু খানিকটা সন্দেহ আছে। হেরোইন আজকাল নাকি ঢাকা এয়ারপোর্ট দিয়ে বিদেশি বাজারে চালান দেয়া হয়। তার মানে এই এলাকার কোনো লোক কাজকর্ম না করেই হঠাৎ করে বড়লোক হয়ে উঠছে কি না, ঢাকা যাচ্ছে কি না ঘন ঘন, এইসব রুটিন ব্যাপার আর কি। প্রায় জনা ত্রিশেক লোককে আমরা সন্দেহ করি, তার মাঝে তোদের হোটেলের মালিকও আছে।