ওপাশ থেকে কী বলল কে জানে, মতিনের গলার স্বর হঠাৎ নেমে আসে। শোনা যায় না, এমন। গোপন জিনিস নিয়ে কথা হচ্ছে, চায় না আমরা শুনি। আমার একটু অস্বস্তি লাগতে থাকে। সফদর আলীর কথা ভিন্ন, মতিনের গলার স্বর নিচু হতেই তাঁর কান যেন খাড়া হয়ে ওঠে, তিনি গলা লম্বা করে ঘাড় বাঁকিয়ে গভীর মনোযোগ দিয়ে মতিনের কথা শোনার চেষ্টা করতে থাকেন। শুধু তাই নয়, মাঝে মাঝে গম্ভীরভাবে মাথা নাড়তে থাকেন, যেন সবকিছু বুঝে ফেলছেন। দেখে আমার তো লজ্জায় মাথা কাটা যাবার মতো অবস্থা।
মতিন কথা শেষ করে একটু অপরাধীর ভঙ্গি করে ফিরে এসে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, সফদর আলী বাধা দিয়ে বললেন, অবস্থা তাহলে সত্যিই খারাপ?
মতিন থতমত খেয়ে বলল, কিসের অবস্থা? হেরোইন তৈরি।
এখানেও তৈরি শুরু করেছে তাহলে?
মতিনের চোয়াল স্কুলে পড়ল, খানিকক্ষণ সে কোনো কথা বলতে পারে না। আবার যখন চেষ্টা করে তখন গলা দিয়ে কোনো শব্দ বের হয় না। খানিকক্ষণ চেষ্টা করে বলল, আপনি মানে আপনি কী ভাবে জানেন?
টেলিফোনে কথা বলছিলেন, তা-ই শুনছিলাম।
কিন্তু টেলিফোনে আমি তো কথা বলছিলাম না, শুনছিলাম।
একটা দুটো কথা তো বলছিলেন, তা থেকেই বোঝা যায়। সফদর আলী গলার স্বর পাল্টে জিজ্ঞেস করলেন, আপনারা যত বার ওদের ল্যাবরেটরিতে হানা দেন তত বার ওরা পালিয়ে যায়?
মতিনের মাথায় মনে হয় বাজ পড়ল। সে ঘুরে প্রায় পড়ে যাচ্ছিল, কোনোমতে একটা চেয়ার ধরে সামলে নেয়। ঢোক গিলে বলল, কী বললেন?
যত বার বর্ডারে ওদের ল্যাবরেটরিতে হানা দেন তত বারই আগে খবর পেয়ে পালিয়ে যায়?
মতিনের মুখ রক্তশূন্য হয়ে যায়, অনেকক্ষণ লাগে ওর কথা বলতে। যখন বলে তখন গলার স্বর শুনে মনে হয় একটা ফাটা বাঁশের ভেতর দিয়ে কথা বলছে। তোতলাতে-তোতলাতে বলল, সা-সা ঘাতিক গোপন ব্যাপার এটা, সারা দেশে মাত্র দশ বার জন লোক জানে। বাইরের কিছু দেশ সাহায্য করছে খবরাখবর দিয়ে, কিন্তু আপনি কী ভাবে জানলেন?
সফদর আলীর মুখ খুশিতে হাসি হাসি হয়ে ওঠে, কেন ও তো খুবই সহজ। কথা বলতে বলতে আপনি একসময় বললেন, অ্যাসিড। অ্যাসিড কোথায় কাজে লাগে, হেরোইন তৈরি করতে। তার মানে এখানে কোথাও হেরোইন তৈরি হচ্ছে। এখন পপি ফুলের সময়, পপি ফুল থেকে হেরোইন তৈরি হয় এ তো সবাই জানে। মতিনের দিকে আর তাকানো যাচ্ছিল না। কী একটা বলতে যাচ্ছিল। সফদর আলী বাধা দিলেন। তারপর একসময় বললেন, “চিড়িয়া”, পুরোটা শুনতে পাই নি, নিশ্চয়ই বলেছেন “চিড়িয়া উড় গিয়া”, মানে পাখি উড়ে গেছে। তার মানে কী হতে পারে? অতি সহজ—আপনারা যখন ল্যাবরেটরিতে হানা দিয়েছেন সবাই আগে খবর পেয়ে পালিয়ে গেছে। বোঝা কঠিন কি?
মতিনের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ আমার একটু ভয় ভয় করতে থাকে, সে ফ্যাকাসে মুখে এক বার সফদর আলীর দিকে, এক বার আমার দিকে তাকাচ্ছে। আমার মনে হচ্ছিল কেঁদে দেবে। কিন্তু কাঁদল না। কাঁদো কাঁদো মুখে বলল, হেরোইন ব্যাপারটা আপনি ঠিকই ধরেছেন।
সফদর আলী বললেন, বললাম না, খুবই সহজ ব্যাপার।
মতিন বলল, কিন্তু ধরেছেন একেবারে ভুল করে। আমি যখন “অ্যাসিড” কথাটা বলেছি, তখন আমার উপরওয়ালার অ্যাসিড অ্যাসিড মন্তব্যের কথা বলছিলাম। যখন চিড়িয়ার কথা বলেছি, তখন এক জন ইনফরমারের কথা বলছিলাম, সে হচ্ছে এক আজব চিড়িয়া।
এবারে সফদর আলীর চোয়াল ঝুলে পড়ে। অবিশ্বাসের ভঙ্গি করে কী একটা বলতে গিয়ে তোতলাতে থাকেন। আমি কী করব বুঝতে না পেরে বোকার মতো হেসে উঠি, সে হাসি আর কিছুতেই থামাতে পারি না। আমার দেখাদেখি প্রথমে মতিন তারপর সফদর আলীও হাসতে শুরু করেন।
অনেকক্ষণ লাগে আমাদের হাসি থামাতে। তার ভেতর আবার চা এসে যায়। আমরা খেয়ে একটু ধাতস্থ হয়ে নিই। মতিন পুরো ব্যাপারটিতে এত অবাক হয়েছে যে বলার নয়, সম্পূর্ণ ভুল জিনিসের উপর ভিত্তি করে কেউ যে এরকম পুরোপুরি একটা সত্যি জিনিস বের করে ফেলতে পারে, সেটা নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস হয় না। ব্যাপারটা আমরা যখন জেনেই গেছি তখন আর গোপন করে কী হবে। মতিন সবকিছু খুলে বলে, অবশ্যি আমাদের কথা দিতে হয় সেটা কাউকে বলব না। জিনিসটা জানাজানি হয়ে গেলে হেরোইন কারবারিদের আর ধরা যাবে না।
হেরোইন হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ মাদকদ্রব্যের একটা। খুব সহজেই মানুষ হেরোইনে আসক্ত হয়ে পড়ে। তখন নিয়মিত হেরোইন না নিয়ে উপায় থাকে না। পাশ্চাত্যে যত অপরাধ হয় তার বড় একটা কারণ হচ্ছে এই হেরোইন। পৃথিবীর নানা দেশে এটা তৈরি হয়, তারপর গোপনে পাঠানো হয় পাশ্চাত্যে। কোটি কোটি টাকার ব্যবসা এই হেরোইন দিয়ে। আগে এটা বার্মায় তৈরি হত, সেখানে পুলিশের ধাক্কা খেয়ে এখন সীমান্ত পার হয়ে এদেশে চলে এসেছে। পাহাড়ের উপর গোপন ল্যাবরেটরিতে তৈরি হচ্ছে হেরোইন। সবচেয়ে মজা হচ্ছে, যত বার খবর পেয়ে ওদের ধরতে গিয়েছে, ওরা কী ভাবে কী ভাবে খবর পেয়ে পুরো ল্যাবরেটরি তুলে পালিয়ে গেছে। ল্যাবরেটরি অবশ্যি এমন কিছু জমকালো ব্যাপার নয়। ছোট ছোট বাসনপত্র, কোরোসিনের চুলো, কিছু কেমিক্যাল সরিয়ে নেয়া এমন কিছু কঠিন ব্যাপার নয়। সবচেয়ে যেটা দুশ্চিন্তার বিষয় সেটা হচ্ছে প্রত্যেক বারই ওরা আগে কী ভাবে জানি খবর পেয়ে যায়। কেউ নিশ্চয়ই আগে থেকে খবর দিয়ে দেয়। কী ভাবে সেটা হয় কেউ বলতে পারছে না। অনেকে সন্দেহ করছে পুলিশে বোধহয় ওদের লোক আছে। ব্যাপারটা তাই বাড়াবাড়ি রকম গোপন।