কী হল?
এক জন লোক অনেকক্ষণ থেকে আমাদের পিছু পিছু ঘুরছে।
সফদর আলী আগেও অনেক বার দাবি করেছেন, তাঁকে নাকি সি, আই এ এবং কে. জি. বি.-র লোকেরা অনুসরণ করে বেড়ায়, কখনো বিশ্বাস করি নি। এবারেও আমি কথাটা হেসে উড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করলাম, কিন্তু সফদর সাহেব ভুরু কুঁচকে চিন্তিত মুখে গোঁফ টানতে লাগলেন। আমি একটু ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করলাম, কোন লোকটা?
আসেন, দেখাচ্ছি।
বাজার থেকে বের হয়ে একটু হেঁটে এগিয়ে যেতেই দেখি সত্যি তাই। আমরা একটু এগুতেই একটা লোক এগোয়, আমরা দাঁড়াতেই সে দাঁড়িয়ে পড়ে।
ভয়ে আমার হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে কালঘাম ছুটে যাবার মতো অবস্থা। কী করব বুঝতে পারছিলাম না, বাজারে ভিড়ের মধ্যেই ভালো ছিলাম, রাস্তাটা এদিকে আবার বেশ নির্জন। তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে বাজারে ফিরে যাব কি না ভাবছিলাম। হঠাৎ দেখি লোকটার হাতে একটা টর্চলাইট জ্বলে উঠল, আলো ফেলে ফেলে লোকটা এগিয়ে আসতে থাকে সোজা আমার দিকে। কাছে এসে আমার মুখে আলোটা ফেলে মেঘস্বরে বলল, দাঁড়ান এখানে।
ভয়ে আমার কাপড় জামা-নষ্ট হবার অবস্থা, তোতলাতে তোতলাতে কোনোমতে বললাম, আমি?
আমার ধারণা ছিল লোকটা নিশ্চয়ই আমাকে সফদর আলী বলে ভুল করেছে; কিন্তু দেখা গেল তা নয়। লোকটা পকেটে হাত ঢুকিয়ে একটা কালো কুচকুচে পিস্তল বের করে আনে, আমার দিকে তাক করে বলে, হ্যাঁ, আপনি। একটা টু শব্দ করলে গুলি করে খুলি উড়িয়ে ঘিলু বের করে দেব।
আমি মাথা ঘুরে প্রায় পড়ে যাচ্ছিলাম, তার মাঝে দেখি সফদর আলী পকেটে হাত ঢুকিয়ে কী একটা জিনিস বের করে লোকটার দিকে তাক করেছেন। কিছু বোঝার আগেই তিনি হঠাৎ সুইচ টিপে দিলেন। বিদ্যুৎ ঝলকের মতো একটা নীল আলো বের হল। আর আমি অবাক হয়ে দেখলাম, লোকটা আর্তনাদ করে দশ হাত দূরে গিয়ে আছড়ে পড়ল। হাত থেকে টর্চ আর পিস্তল ছিটকে পড়েছে রাস্তায়। তার মাঝে সফদর আলী দৌড়ে লোকটার বুকের উপর পা দিয়ে দাঁড়িয়ে হুঁঙ্কার দিয়ে বলছেন, একটু নড়বে না, নড়লেই আরেকটা দেব, ডাবল করে দেব পাওয়া।
আমি বললাম, কথা বলছেন কি? আরেকটা দিয়ে দিন আগে, নড়ছে যে এখনো।
লোকটার নড়ার আর কোনো ইচ্ছা নেই, কাতর স্বরে বলল, ইকবাল, আমাকে বাঁচা। আমি মতিন, ঠাকুরপাড়ার মতিন।
আমার সম্বিত ফিরে আসে, দৌড়ে টর্চলাইটটা তুলে লোকটার দিকে এগিয়ে যাই, সত্যিই মতিন, চোখে আলো ফেলে আমার চোখ ধাঁধিয়ে রেখেছিল বলে দেখতে পাই নি, না হয় মতিনকে না চেনার কোনো কারণ নেই, ও আমার অনেক দিনের বন্ধু। আমার মুখে কথা সরে না, তোতলাতে তোতলাতে বলি, তু-তু-তু-তুই–
সফদর আলী ততক্ষণে মতিনের বুক থেকে পা সরিয়ে তাকে টেনে তোলার চেষ্টা কছেন। সে উঠে হাতড়ে হাতড়ে পিস্তলটা তুলে নেয়, বার কয়েক লম্বা নিঃশ্বাস নিয়ে বলে, বাজারে দেখলাম তোকে। ভাবলাম, তুই যেরকম ভীতু, একটু মজা করি তোর সাথে। সর্বনাশ আরেকটু হলে তো মরেই গিয়েছিলাম!
আমি পরিচয় করিয়ে দিলাম, ইনি সফদর আলী, আমার বন্ধু।
মতিন তখনো হাঁপাচ্ছে, কোনোমতে বলল, খালি গল্প শুনেছিলাম স্টান্টগানের, আজ দেখলাম।
স্টান্টগান?
হ্যাঁ, যেটা দিয়ে মারলেন আমাকে।
ও! সফদর আলী পকেটে হাত ঢুকিয়ে ছোট হাতলওয়ালা জিনিসটা বের করলেন, এটাকে স্টান্টগান বলে নাকি? জানতাম না তো!
জানতেন না মানে? মতিন অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, লাইসেন্স করান নি?
লাইসেন্স?
বন্দুক লাইসেন্স করাতে হয় জানেন না? কে বিক্রি করেছে আপনাকে?
আমাকে কেউ বিক্রি করে নি, আমি নিজেই তৈরি করেছি।
মতিন খানিকক্ষণ অবাক হয়ে সফদর আলীর দিকে তাকিয়ে থাকে।
আমি বললাম, সফদর আলী হচ্ছেন বিজ্ঞানী মানুষ, অনেক কিছু ইনি তৈরি করেছেন।
সফদর আলী বিরস মুখে স্টান্টগানটার দিকে তাকিয়ে ছিলেন, খানিকক্ষণ পর আস্তে-আস্তে বললেন, জন্ম নিতে-নিতে একটু দেরি হয়ে গেল।
আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কেন?
একটু ঝাজিয়ে উত্তর দিলেন, দেখছেন না, যেটাই তৈরি করি সেটাই আগে আবিষ্কার হয়ে গেছে! বাকি আছে কী?
মতিন কী একটা বলতে যাচ্ছিল, আমি বাধা দিয়ে বললাম, কাছাকাছি কোনো বাথরুম আছে? তুই যখন বন্দুকটা ধরলি, ভয়ে পেটটা কেমন মোচড় দিয়ে উঠল, এখন মনে হচ্ছে—
হ্যাঁ, আছে। ঐ তো ওদিকে হঠাৎ করে পেট খারাপ নাকি?
সফদর আলী বললেন, নার্ভাস ডাইরিয়া। ভয় পেলে হয়, হঠাৎ করে ইনটেস্টাইনে—
ব্যাখ্যাটা শোনার সময় ছিল না, মতিনের সাথে আমি দৌড়ালাম।
মতিন কী কাজ করে বলা মুশকিল। পুলিশ কিংবা সেনাবাহিনীর ইন্টেলিজেন্সের লোক। পরিষ্কার করে কখনো বলে না, কে জানে হয়তো বলা নিষেধ। একসাথে দু’জন কলেজে গেছি, কিন্তু এখন দেখা হয় খুবই কম। খুব ব্যস্ত ভাব নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। তাকে এখানে দেখব কখনো চিন্তাও করি নি। কোথায় এসেছে, কী করছে জিজ্ঞেস করে লাভ নেই, প্রশ্নগুলো খুব কায়দা করে এড়িয়ে যায়। আমাদের দুজনকে তার বাসায় নিয়ে এসেছে, কাছেই বাসা। আমাদের জন্যে চায়ের ব্যবস্থা করে দিয়ে এসে মতিন খুটিয়ে খুটিয়ে সফদর আলীকে দেখে, একটু ভয়ে ভয়েই। এরকম একটা সংঘর্ষ দিয়ে পরিচয়, ভয় করে উপায় কি? চেয়ার টেনে একটু দূরে বসে, সফদর আলী একটু ক্ষেপে তাকে আরেকটা শক দেন, সেই ভয়ে কি না কে জানে।
আমি ভয়টা ভাঙিয়ে দেয়ার জন্যে কী একটা বলতে যাচ্ছিলাম, ঠিক তখন টেলিফোন বেজে ওঠে। মতিন ব্যস্ত হয়ে গিয়ে টেলিফোনটা ধরে, হ্যালো, কে? মজুমদার?