বলাই বাহুল্য, সফদর আলীকে ঘিরে একটা ছোটখাট ভিড় জমে গেল। তিনি সেটাকে গ্রাহ্য না করে বললেন, চলুন প্ল্যাটফরমে যাই।
চলুন—আমি তাঁর মতো লোজনের কৌতূহলের বিষয় হয়ে অভ্যস্ত নই, তাই তাড়াতাড়ি তাঁর পিছু পিছু সরে পড়ার চেষ্টা করি। সৌভাগ্যবশত প্ল্যাটফরমে এক জন আধপাগল গোছের লোক তার রসগোল্লায় মিষ্টি কম ছিল দাবি করে এক জন মিষ্টির দোকানির সাথে এমন হৈচৈ করে ঝগড়া শুরু করেছে যে কৌতূহলী দর্শকের ভিড়টা আমাদেরকে ঘিরে তৈরি না হয়ে তাদের দিকে সরে গেল। আমি গলা নামিয়ে বললাম, সবকিছু এনেছেন তো?
হ্যাঁ। কানের হেডফোনটা দেখিয়ে বললেন, সময়টা খারাপ, তাই এটা তৈরি করে নিলাম।
কী এটা?
আবহাওয়া অফিস। সরাসরি স্যাটালাইটের সাথে যোগাযোগ। ফ্রিকোয়েন্সিটা বেশি সুবিধের নয়, একটু ডিস্টরশান হয়।
আমি কিছু না বুঝে বললাম, ও।
কিছুক্ষণের মাঝেই ট্রেন লাগিয়ে দিল। আমরা উঠে মালপত্র গুছিয়ে নিয়ে বসি। ট্রেনে বেশ ভিড়। ঘুমাতে পারব কি না সন্দেহ আছে, কিন্তু এক রাতের ব্যাপার, আমরা বেশি মাথা ঘামালাম না।
কক্সবাজার পৌঁছলাম পরদিন প্রায় বিকেলের দিকে। রাতে ভাললা ঘুম হয় নি, সারা দিন বাসের ঝাঁকুনি। কিন্তু সে হিসেবে বেশ ঝরঝরে আছি, মনে হয় সকালে সফদর আলী যে দুটো ট্যাবলেট খাইয়ে দিয়েছিলেন তার ফল। কালোমতন বিদঘুটে ট্যাবলেট, ভেতরে কী ছিল কে জানে! বাসে আমাদের পাশে দু’ জন কলেজের ছেলে বসেছিল। তাদের কাছে শুনলাম কক্সবাজার পার হয়ে আরো পাঁচ ছয় মাইল গেলে নাকি চমৎকার নিরিবিলি এলাকা। একটা নাকি চমৎকার থাকার জায়গা আছে। ছেলে দু’টি আমাদের জায়গাটার নাম, কী ভাবে যেতে হয় গুছিয়ে বলে দিল। আমার নিজের এত বেশি নিরিবিলিতে যাওয়ার ইচ্ছা ছিল না, কিন্তু সফদর আলীর খুব উৎসাহ। লোকজনের ভিড় তাঁর ভালো লাগে না, তিনি যেভাবে চলাফেরা করেন, সবসময়েই তাঁকে ঘিরে একটা ছোটখাট ভিড় জমে ওঠে, তিনি যে নিরিবিলিতে থাকতে চাইবেন এতে অবাক হবার কী আছে?
খুঁজে খুঁজে আমরা যখন ঠিক জায়গায় হাজির হলাম, তখন সন্ধ্যা পার হয়ে গেছে। শুক্লপক্ষের রাত, চমৎকার চাঁদ উঠেছে। সমুদ্রে তার প্রতিফলন দেখে মাথা খারাপ হয়ে যায়, সফদর আলীর মতো এরকম কট্টর বিজ্ঞানী মানুষ পর্যন্ত খানিকক্ষণ হাঁ করে তাকিয়ে থেকে বললেন, কী চমৎকার লাগছে! দেখেছেন কেমন কোমল একটা ভাব?
আমি মাথা নাড়লাম।
আসলে ব্যাপারটা কি জানেন? চাঁদের আলোতে রং বোঝা যায় না। আমাদের চোখের রেটিনাতে তখন শুধু রডগুলো কাজ করে। রডগুলো রং ধরতে পারে না, তাই কন্ট্রাস্ট কমে যায়, মনে হয় খুব কোমল।
জিনিসটি বুঝিয়ে দেয়ার পরও আমার কিন্তু ভালোই লাগে।
আমরা হোটেলের দরজা খুলে ভেতরে এসে ঢুকি। আমাদের শব্দ শুনে মাঝবয়সী এক জন লোক বেরিয়ে আসেন। ভদ্রলোকের পোশাক দেখার মতো, শৌখিন মানুষের হাতে পয়সা হলে যা হয়। চকচকে কাপড়-জামা তো আছেই, তার উপর হাতে সোনার ঘড়ি, আঙুলে মোটা মোটা আংটি, গলায় সোনার চেন। ভদ্রলোক আমাদের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন, আমি বললাম, আপনাদের ঘর খালি আছে? সপ্তাহ দুয়েক থাকার মতো?
দু’ সপ্তাহ? ভদ্রলোক খুশি না হয়ে মনে হল একটু শঙ্কিত হয়ে ওঠেন।
জি।
আছে ঘর কয়েকটা। কাউন্টার থেকে কাগজপত্র বের করতে করতে বললেন, কোথা থেকে আসছেন?
ঢাকা।
প্লেনে এলেন?
না, ট্রেন আর বাস।
ও! তাহলে তো আপনাদের অনেক ধকল গেছে। ঠিক আছে, আগে আপনাদের ঘর দেখিয়ে দিই, দু’জনের জন্যে ভালো একটা ঘর আছে। নাম লেখালেখি করার অনেক। সুযোগ পাওয়া যাবে। ভদ্রলোক কাউন্টার থেকে চাবি বের করে এগিয়ে যান, আমরা পিছু পিছু যেতে থাকি।
ঘর দেখে আমি মুগ্ধ হয়ে যাই। চমৎকার ঝকঝকে ঘর। দু’পাশে দুটি সুদৃশ্য বিছানা, জানালার পর্দা টেনে দিলে সমুদ্র দেখা যায়। ঘরের সাথে বাথরুম, সামনে বারান্দা। ভেতরে টেবিল, টেবিলে সুদৃশ্য কাচের জগে পানি। এত আয়োজনের তুলনায় ঘরভাড়া খুব কম, আমি অবাক না হয়ে পারি না। ভদ্রলোকের সাথে কথা বলে জানলাম তিনিই হোটেলের মালিক, নিজেই দেখাশোনা করেন। আত্মীয়স্বজন বিশেষ। নেই। একা একা নিরিবিলি জীবনটা কাটিয়ে দিতে চান। আমাদের গুছিয়ে নেয়ার সুযোগ দিয়ে ভদ্রলোক চলে গেলেন, যাওয়ার আগে বলে গেলেন কোথায় আমরা খেতে পারব, এখান থেকে প্রায় মাইলখানেক দূরে একটা নাকি ভালো রেস্তরা আছে।
জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে দু’জনে অনেক সময় নিয়ে গোসল করে পরিষ্কার জামাকাপড় পরে বের হলাম। চাঁদের আলোতে সমুদ্রের তীর দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে মনটা অকারণেই খুশি হয়ে ওঠে। খুঁজে খুঁজে রেস্তরাঁটি বের করে খেয়ে নিলাম দুজনে। খুব উঁচুদরের খাবার, সেরকম দাবি করব না, এ অঞ্চলের মানুষেরা বোধহয় ঝাল একটু বেশিই খায়। সফদর আলীর পকেটে “ঝাল ধ্বংস” ট্যাবলেটটা না থাকলে খেতে পারতাম কি না সন্দেহ। একটা ছোট ট্যাবলেট মাছের ঝোলে ছেড়ে দিতেই সে সব ঝাল শুষে নিল, সত্যি বলতে কি, স্বাদও খানিকটা শুষে নিয়ে স্বাদটা কেমন জানি পানসে করে দিল। পেটে খিদে ছিল, তাই খেতে বিশেষ অসুবিধে হয় নি।
খেয়ে বের হয়েছি, একটু হাঁটতেই মনে হল যেন একটা মাছের বাজার। মাছের আশটে গন্ধে কাছে যাওয়া যায় না। বেশ রাত হয়েছে, কিন্তু অনেক লোকজন। খাওয়ার ঠিক পরপরই এরকম আশটে গন্ধ ভালো লাগার কথা নয়, কিন্তু সফদর আলী গো ধরলেন তিনি বাজারটা দেখবেন। সমুদ্র থেকে মাছ ধরে আনা হয়েছে, বড় বড় কেরোসিনের বাতি জ্বালিয়ে পাইকারি বেচাকেনা হচ্ছে। অদ্ভুত অদ্ভুত সব মাছ, দেখে তাক লেগে যায়। ভিড়ে এক জায়গায় মাঝারি একটা হাঙরের দিকে তাকিয়ে ছিলাম, সফদর আলী হঠাৎ গলা নামিয়ে বললেন, সাবধান!