কী কী আছে ভ্ৰমণবন্দির ভেতরে?
একটা চুম্বক, ইনডাকশান কয়েল, তামার তার, একটা আলট্রাসোনিক অসিলেটর, একটা ছয় ভোল্টের ব্যাটারি–
আমি চোখ কপালে তুলে বললাম, ভ্রমণ করতে এসব লাগে নাকি? এই চুম্বক, ব্যাটারি?
কী বলছেন আপনি? রাঙামাটি পাহাড়ে যখন হারিয়ে গেলাম, কী কুয়াশা, কোনদিকে যাব জানি না। চুম্বকটা ঝুলিয়ে দিতেই উত্তর-দক্ষিণ বের হয়ে গেল, তারপর হাতড়ে হাতড়ে আধ ঘন্টায় তাঁবুতে ফিরে এলাম।
তাবু? আমি অবাক হয়ে বললাম, আপনি তাঁবুতে থাকেন?
রাঙামাটির ঐ পাহাড়ে আমার জন্যে হোটেল কে বানাবে?
সাপখোপ?
ইনডাকশান কয়েল কি শুধু শুধু নিই? তাঁবুকে ঘিরে তামার তার থাকে, ইনডাকশান কয়েল দিয়ে হাই ভোল্টেজ করে রাখি, সাপখোপ ধারে-কাছে আসে না।
আমি ঢোক গিলে বললাম, আমাদের কি তাঁবুতেই থাকতে হবে?
থাকার জায়গা না থাকলে তাঁবুতে থাকব। আমার দুটো স্লিপিং ব্যাগ আছে, আপনার জন্যে একটা নিয়ে নেব।
বন-জঙ্গলে তাঁবুতে থাকতে ভয় করে না আপনার?
কী বলেন আপনি, ভয় করে না আবার? ভীষণ ভয় করে! সফদর আলী শিউরে ওঠেন একবার।
আপনি কি বন্দুকটলুক নিয়ে যান?
বন্দুক? সফদর আলী এমনভাবে আমার দিকে তাকালেন যেন আমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। বললেন, বন্দুক দিয়ে কী করব? ভূতকে কখনো গুলি করা যায়?
আপনি ভুতের ভয় পান? জঙ্গলে আপনি ভূতের ভয় পান? আমি অবাক হয়ে সফদর আলীর দিকে তাকিয়ে থাকি।
আপনি কী ভাবছিলেন?
এই, বাঘ-ভালুক–
বাঘ-ভালুককে ভয় পাবার কী আছে? গায়ে বাঘবন্দি তেল মেখে ঘুমাবেন, বাঘ ধারে-কাছে আসবে না। আলট্রাসনিক বিপার আছে, বিপ বিপ শব্দ করতে থাকে, পোকা-মাকড় পর্যন্ত পালিয়ে যাবে।
ওরকম শব্দ করতে থাকে, তার মাঝে আপনি ঘুমান কেমন করে?
সফদর আলী একটু হেসে বললেন, ঐ তো বললাম না আলট্রাসোনিক শব্দের কাপন এত বেশি যে মানুষ শুনতে পায় না, কিন্তু পশুপাখি পোকা-মাকড় ঠিকই শোনে।
আমি মাথা চুলকে বললাম, বন-জঙ্গলে এই অন্ধকারে একা একা তাঁবুতে—
–অন্ধকার? অন্ধকার আপনাকে কে বলল?
রাতে অন্ধকার হবে না, বাতি জ্বালিয়ে আলো আর কতটুক পাওয়া যায়?
বাতি আমি কখনোই জ্বালাই না, পোকা মাকড় এসে ভিড় করে। আমার ইনফ্রারেড চশমাটা পরে নিই, পরিষ্কার দেখা যায় তখন।
ইনফ্রারেড চশমা? সেটা কী জিনিস?
সফদর আলী হঠাৎ গলা নামিয়ে ফেললেন। ফিসফিস করে বললেন, খবরদার, কাউকে যেন বলবেন না, অন্ধকারে দেখা যায় এরকম চশমার জন্যে সবরকম লোক ব্যস্ত হয়ে আছে।
এদিক-সেদিক তাকিয়ে যখন দেখলেন কেউ তাঁর কথা শুনছে না, তখন আমাকে বোঝালেন, ইনফ্রারেড চশমাটি কী জিনিস। আমরা যে আলো দেখতে পাই তার দৈঘ্য যদি বেশি বা কম হয়ে যায়, তাহলে সেটাকে আর দেখা যায় না। যেসব আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য বেশি, তাকে ইনফ্রারেড বলে, সেটা নাকি আশ্চর্য কিছু নয়, যে কোনো গরম জিনিস থেকেই অদৃশ্য ইনফ্রারেড আলো ছড়ায়। সফদর আলী একটা চশমা তৈরি করেছেন, যেটা এই ইনফ্রারেড আলোকে সাধারণ আলোতে পরিণত করে দেয়। তাকে সেজন্যে কয়েকটা সি. সি. ডি. ব্যবহার করতে হয়েছে। সেটা কী জিনিস সফদর আলী আমাকে অনেকক্ষণ বোঝানোর চেষ্টা করলেন। আমি তবু ঠিক বুঝতে পারলাম না। যেটুকু বুঝলাম তাতেই চমৎকৃত হলাম, একটা পেশাদার চোর একটা ইনফ্রারেড চশমা পেলে কী খুশি হবে, সেটা আমার জন্যে কল্পনা করাও মুশকিল।
সফদর আলী ভ্রমণের জন্যে আরো কী কী আবিষ্কার করেছেন বললেন, তার মাংস গুল্লি ‘মাছ গুল্লি’ এবং ‘সবজি গুল্লি’ বলে এক ধরনের ট্যাবলেট রয়েছে, সেগুলো মাংস, মাছ বা সবজিতে ছেড়ে দিয়ে পানি দিয়ে গরম করে নিলেই নাকি রান্না হয়ে যায়। তাঁর সেগুলো বেশি ব্যবহার করতে হয় না, কারণ তাঁর যে স্বাস্থ্য গুল্লি আছে, সেটা একটা খেলেই নাকি সারা দিন কিছু খেতে হয় না। এ ছাড়া আছে তাঁর দশবাহারি চুলো, মগ, ডেকচি, সসপ্যান, বালতি, চাকু, শাবল, কোদাল, টেবিল-ল্যাম্প এবং ইঁদুর মারার কল। এই দশটি জিনিসের কাজ করতে পারে বলে এর নাম দশবাহারি চুলো। তার আরেকটি আবিষ্কারের নাম হচ্ছে বাইনো ক্যামেরা। সেটা একই সাথে বাইনোকুলার এবং ক্যামেরা। শুধু তা-ই নয়, সে ক্যামেরাতে নাকি ত্রিমাত্রিক ছবি ওঠে। সফদর আলীর সবচেয়ে মজার আবিষ্কার হচ্ছে “ভূতটিপি”, এটি আসলে একটি ছোট ক্যাসেট রেকর্ডার। ভয় পেলেই এটা তিনি টিপে দেন। তখন সেটা ক্রমাগত আয়াতুল কুরসি পড়তে থাকে। আয়াতুল কুরসি পড়লে নাকি কখনো ভূত ধারে-কাছে আসে না।
আমরা আমাদের যাওয়ার পরিকল্পনা করতে থাকি। ঠিক করা হল দু’সপ্তাহের জন্যে কক্সবাজার যাব, সেখান থেকে এদিক-সেদিক ঘোরাঘুরি করা যাবে। বান্দরবন কাছেই, সেখানে শ ঙ্খ নদী দিয়ে পাহাড়ের ভেতর পর্যন্ত যাওয়া যায়। খুব নাকি সুন্দর জায়গা। ঢাকা থেকে চাটগাঁ পর্যন্ত ট্রেনে যাব, সেখান থেকে বাস। রাতের ট্রেনে রওনা দিলে ভোরে চাটগাঁ পৌঁছে যাব, তাহলে দিন থাকতে থাকতে কক্সবাজারে হাজির হওয়া যাবে।
নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট সময়ের অনেক আগেই আমি স্টেশনে গিয়ে হাজির হলাম। সাথে একটা স্যুটকেস আর একটা ছোট ব্যাগ। মা জোর করে একটা টিফিন ক্যারিয়ার ধরিয়ে দিয়েছেন, ভেতরে মাংস-পরোটা থাকার কথা। টিকিট আগে থেকে কিনে রেখেছিলাম, তাই স্টেশনের সামনে সফদর আলীর জন্যে অপেক্ষা করতে থাকি। বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না, কাঁটায় কাটায় ঠিক সময়ে তিনি এসে হাজির। তাঁকে দেখে আমার আক্কেল গুড়ুম, পিঠে একটা অতিকায় ঝোলা নানারকম বেল্ট দিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে তাঁর শরীরের সাথে বাঁধা। ঝোলা থেকে নানারকম জিনিস বের হয়ে আছে, তলায় ছোট ছোট চাকা, মনে হল উপরে স্টিয়ারিং হুঁইলের মতো কী একটা আছে, প্রয়োজনে জিনিসটা ছোট একটা গাড়িতে পাল্টে গেলেও আমি অবাক হব না। সফদর আলীর মাথায় একটা বারান্দাওয়ালা টুপি। টুপির উপরে একটা বাতি, আপাতত সেটা নেভানো আছে। টুপি থেকে দুটি হেডফোনের মতো জিনিস নেমে এসেছে। টুপির উপরে রেডিওর অ্যান্টেনার মতো কী-একটা জিনিস বেরিয়ে আছে। তাঁর পরনে খাকি শার্ট আর গাঢ় নীল রঙের একটা প্যান্ট শার্ট আর প্যান্টে সঠিক পকেটের সংখ্যা বলা মুশকিল। বাইরে থেকে অনুমান করি পঞ্চাশ থেকে সত্তরের ভেতরে হবে। তার গলায় তাবিজের মতো কী একটা ঝুলছে। সেটা যদি তাঁর বিখ্যাত ভূতটিপি হয়, আমি অবাক হব না। তাঁর ডান হাতে লাঠির মতো একটা জিনিস, হাতের কাছে অসংখ্য সুইচ দেখে বুঝতে পারি এটি সাধারণ লাঠি নয়।