আমার ডাক্তার বন্ধুটি আমাকে অনেকক্ষণ টেপাটেপি করে দেখল। পাছে সে জিনিসটা হেসে উড়িয়ে দেয়, আমি তাই আমার সহকর্মীর শালার আপন ভায়রা ভাইয়ের ঘটনাটি খুলে বললাম। সে মন দিয়ে শুনে মাথা নেড়ে বলল, তোমার অবস্থা অনেক দূর এগিয়ে গেছে। আমি ঠিক জানি না কত দূর কি করতে পারব। কিন্তু চেষ্টা করতে তো দোষ নেই।
আমি চিঁ চিঁ করে বললাম, কী মনে হয় তোমার? বেঁচে যাব এ যাত্রা?
দেখি, অসুখটা তো সহজ নয়।
কি নাম অসুখটার?
অসুখ তো একটা নয়, অনেকগুলো। তাই এর ঠিক একটা নাম নেই। তবে যার এই অসুখগুলো হয় তার নাম হাইপোকনড্রিয়াক।
হাইপোকনড্রিয়াক! কী বীভৎস নাম! কোথায় যেন শুনেছি নামটা ঠিক মনে করতে পারলাম না। ডাক্তার বন্ধুটি একটা বড় ওষুধের বাক্স ধরিয়ে দিয়ে বলল, বাসায় গিয়ে শুয়ে থাকা খাওয়ার পর দুটো করে ট্যাবলেট দিনে দশ বার—খবরদার ভুল যেন না হয়।
আমি চলে আসার সময় বলল, তোমার আর আসতে হবে না, রাতে আমি আসব। খালাম্মা ভালো আছেন তো? আর শোন, ভালো-মন্দ যদি কিছু খেতে চাও, খেয়ে নিও। বুঝতেই তো পারছ দু’দিনের দুনিয়া!
ডাক্তার যখন রোগীকে বলে, দু’দিনের দুনিয়া—ভালো-মন্দ কিছু খেয়ে নিও, তখন রোগীর মানসিক অবস্থা কেমন হয় সেটা নিশ্চয়ই আর বুঝিয়ে দিতে হয় না। আমি কোনোমতে রিকশা করে বাসায় রওনা দিই, মাথা ঘুরতে থাকে আমার। মনে হয়। পড়ে যাব রিকশা থেকে। কাওরান বাজারের ভিতর দিয়ে যাওয়ার সময় হঠাৎ চায়ের দোকানে সফদর আলীকে দেখে রিকশা থামিয়ে নেমে পড়লাম। মরি-বাঁচি ঠিক নেই, সফদর আলীর সাথে একবার দেখা করে যাই। সফদর আলী আমাকে দেখে একটু চমকে ওঠেন। বললেন, সে কী! আপনার এ কী চেহারা! কী হয়েছে?
অনেককিছু। একটা অসুখ তো নয়, অনেকগুলো।
কী সর্বনাশ! কবে হল?
এই তো, অনেকদিন থেকে নিশ্চয়ই। মরি-বাঁচি ঠিক নেই।
কিসের অসুখ?
অসুখটার নাম জানি না, তবে যার হয় তাকে বলে হাইপোকনড্রিয়াক।
কী বললেন?
হাইপোকনড্রিয়াক।
কে বলেছে আপনাকে?
আমার মনে হল সফদর আলীর মুখে একটা হাসি উঁকি দিয়ে গেল। একটু রেগে ললাম, আমার এক বন্ধু ডাক্তার আছে, মস্ত বড় ডাক্তার–
সফদর আলী সত্যি দুলে দুলে হাসতে থাকেন। বিজ্ঞানী মানুষের দয়া-মায়া একটু কম হয় জানতাম, কিন্তু এরকম নিষ্ঠুর হয় ধারণা ছিল না। বললাম, হাসছেন কেন ‘আপনি?
হাইপোকনড্রিয়াক মানে জানেন না আপনি?
না।
হাইপোকনড্রিয়াক মানে হচ্ছে যার কোনো অসুখ নেই, কিন্তু মনে করে তার “অনেক বড় বড় অসুখ আছে।
আমি হতবাক হয়ে থেমে গেলাম। সত্যিই তো! আমিও তো জানতাম শব্দটা, খন এই ভয়ে মাথা গুলিয়ে রয়েছে বলে ধরতে পারি নি। থতমত খেয়ে বললাম, কিন্তু এত বড় বাক্স ভরা ওষুধ দিল যে!
খুলুন দেখি বাক্সটা।
আমি বাক্সটা খুলি। বড় বাক্সের ভেতর একটা মাঝারি বাক্স। মাঝারি বাক্সের ভেতর একটা ছোট বাক্স। ছোট বাক্সটা খুলে দেখি তার ভেতরে কয়টা চিনাবাদাম।
লজ্জায় আমার মাথা কাটা গেল। পাজি বন্ধুটা বলেছে, রাতে আমার বাসায় আসবে, এসে সবার সামনে আমাকে নিয়ে কী ঠাট্টাই না করবে! চিন্তা করে আমার কালঘাম ছুটে যাচ্ছিল। কিন্তু সাথে সাথে আমার আবার ভালোও লাগতে থাকে যে আসলে আমার কোনো অসুখ হয় নি। বুক হালকা হয়ে যায়, শরীর ভালো লাগতে থাকে, হার্ট, কিডনি, লিভার সবকিছু একসাথে ঝরঝরে হয়ে ওঠে।
আমি আর সফদর আলী বসে বসে চিনাবাদামগুলো শেষ করে দিই।
রাতে আমার ডাক্তার বন্ধুটি সত্যি সত্যি তার গাড়ি হাঁকিয়ে এসে হাজির। অনেক দিন থেকে আমার সাথে জানাশোনা, বাসার সবাইকে চেনে। আমাকে নিয়ে বাসার সবার সামনে অনেকক্ষণ খুব হাসাহাসি করল। আমি কী ভাবে অচল হার্ট, ব্রেন, লিভার, কিডনি আর লাংস নিয়ে কোঁকাতে কোঁকাতে তার চেম্বারে এসে হাজির হলাম, সেটা সে বেশ কয়েকবার অভিনয় করে দেখাল। যাওয়ার আগে আমাকে বলে গেল আমার লজ্জা পাবার কিছু নেই, মানুষ যখন খুব কাজের চাপে থাকে তখন এধরনের শারীরিক অসুস্থতার লক্ষণ দেখা যায়। কয়দিন ছুটি নিয়ে কোথাও থেকে ঘুরে এলে সব নাকি ঠিক হয়ে যাবে। ডাক্তার বন্ধুটি আমাকে সপ্তাহ দুয়েকের ছুটি নিয়ে কোনো জায়গা থেকে ঘুরে আসতে বলল।
আমার সপ্তাহ দুয়েকের ছুটি পাওনা ছিল। ঠিক করলাম ছুটিটা নষ্ট না করে কোথাও থেকে ঘুরে আসি। একা একা কোথাও গিয়ে মজা নেই। কাকে নেয়া যায়, কোথায় যাওয়া যায় জল্পনা-কল্পনা করতে থাকি। কক্সবাজার, বান্দরবন, সুন্দরবন, সীতাকুণ্ড, সিলেটের চা বাগান, ময়মনসিংহের গারো পাহাড় যাওয়ার জায়গার অভাব নেই, তবে উপযুক্ত সঙ্গীর খুব অভাব। হঠাৎ আমার সফদর আলীর কথা মনে পড়ে, তাঁকে যেরকম ব্যস্ত দেখায়, বেড়াতে যেতে রাজি করাতে পারব এমন বিশ্বাস ছিল না। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার, বলমাত্র এককথাতে রাজি হয়ে গেলেন! আসলে সফদর আলী ঘুরে বেড়াতে খুব পছন্দ করেন। এমন জায়গা নেই তিনি যেখানে যান নি, ঘুরে ঘুরে তিনি পোক্ত হয়ে উঠেছেন। যখন আমি বললাম, কোথায় গিয়ে কোথায় উঠব, কোথায় থাকব—সফদর আলী তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে বললেন, আমার উপর ছেড়ে দিন, ভ্রমণবন্দিটা নিয়ে নেব, কোনো অসুবিধে হবে না।
ভ্ৰমণবন্দি। সেটা কী জিনিস?
সফদর আলী একটু লাজুকভাবে হেসে বললেন, ভ্রমণের সময় যা যা লাগে, সব একটা ঝোলার মাঝে বন্দি করে রাখা আছে, তাই এর নাম ভ্ৰমণবন্দি। কোথাও যেতে হলে আমি ঘাড়ে করে নিয়ে বেরিয়ে পড়ি।