“কিন্তু পীর সাহেবের কোনো ঐশ্বরিক ক্ষমতা নাই। তিনি যখন পেরেকের বিছানায় শয়ন করেন অথবা লন্ত অঙ্গারের উপর হাঁটিয়া যান তখন কোনোরূপ ব্যথা অনুভব করেন না। কারণ তখন বেশি ব্যথা অনুভব হয় না। ইহার কারণ আগেই বলা হইয়াছে, আবার লিখিয়া আপনাদের ধৈর্যচ্যুতি ঘটাইতে চাহি না। কিন্তু যদি কোনোক্রমে পেরেকের বিছানার একটি মাত্র পেরেক একটু লম্বা হইয়া যায়, তখন শরীরের সমস্ত ওজন সবগুলো পেরেকে বিভক্ত না হইয়া ঐ একটি পেরেকের উপরে পড়িবে এবং অচিন্তনীয় যন্ত্রণার উদয় হইবে। ইহা পরীক্ষা করিবার জন্য আজ গোপনে একটি পেবেকের উপর সুচালো একটি লৌহ-নির্মিত টুপি পরিধান করাইয়া দেওয়া হইয়াছিল। ইহার ফলস্বরূপ পীর সাহেবের যন্ত্রণাকাতর নর্তন-কুন আপনারা স্বচক্ষে অবলোকন করিবেন।
জ্বলন্ত অঙ্গরের তাপধারণ ক্ষমতা অত্যন্ত কম, তাই প্রয়োজনীয় সাবধানতা অবলম্বন করিলে ইহার উপর দিয়া হাঁটিয়া যাওয়া সম্ভব। যদি জ্বলন্ত অঙ্গারের মধ্যে কিছু ধাতব পদার্থ রাখিয়া দেওয়া হয়, তাহা হইলে ব্যাপারটি অন্যরকম হইবে, ধাতব পদার্থ প্রচুর তাপধারণ করিতে পারে এবং কেহ তাহার উপর দিয়া হাঁটিয়া যাওয়ার চেষ্টা করিলে চোখের পলকে পায়ে ফোস্কা পড়িয়া যাইবে। পীর বাবার জোচ্চুরি ধরিবার জন্য গোপনে আগুনের মধ্যে কিছু নাট-বল্ট ফেলিয়া দেওয়া হইয়াছিল, পীর সাহেব যখন ঐ উত্তপ্ত নাট-বতে পা দিবেন তাহার সকল বুজরুকি ধরা পড়িয়া যাইবে। ভাই সকল, আজিকার—”
এর পরে পীরদের পিছনে টাকাপয়সা এবং সময় নষ্ট না করে সেটি কী ভাবে ভালো কাজে ব্যয় করা যায় সেটি পরিষ্কার করে লেখা আছে।
খবরের কাগজটা পড়ে শেষ করে সুলতান সাহেব আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনি ঠিকই বলেছিলেন, খাঁটি পীর পাওয়া কঠিন। পীর যদি খাঁটি মানুষই হবে, তাহলে টাকাপয়সার দিকে এত ঝোঁক কেন?
আজিজ খ বললেন, হ্যাঁ, খামাখা পেটমোটা একটা পীরকে এতগুলো টাকা খাওয়ালাম। ছোট ছেলেটা কত দিন থেকে বলছিল, একটা ম্যাকানো সেট কিনে দিতে–
মাওলা সাহেব বললেন, এমনিতে আমার পিঠে ব্যথা, তার মাঝে সেদিন জোচ্চোর ব্যাটার লাথি খেয়ে
সুলতান সাহেব বললেন, ইকবাল সাহেব, আসলে আপনার কথাই আমাদের আগে শোনা উচিত ছিল। পীর-দরবেশের পিছনে টাকা নষ্ট না করে টাকাগুলো একত্র করে গরিব বাচ্চাদের জন্যে দুধ বা পুষ্টিকর খাবারের ব্যবস্থা করলে হত।
মাওলা সাহেব কথাটা লুফে নিয়ে বললেন, হ্যাঁ, আমরা এত জন মানুষ, সবাই যদি মাসে দশ টাকা করেও দিই অনেক টাকা উঠে যাবে।
ইদরিস সাহেব বললেন, ইকবাল সাহেব এসব ব্যাপার ঠিক বোঝেন। তাঁকে প্রেসিডেন্ট করে একটা কমিটি করে ফেললে কেমন হয়?
মাওলা সাহেব মাথা নেড়ে বললেন, মানুষকে দেখে বোঝা মুশকিল কার ভিতরে কী আছে। এই যে ইকবাল সাহেব, দেখলে মনে হয় মহা ধান্ধাবাজ। অথচ দেখেন ভিতরে কেমন একটা দরদি মন লুকিয়ে আছে।
তাহলে সেটাই ঠিক থাকল, বৃদ্ধ অ্যাকাউনটেন্ট বললেন, আমরা টাকাপয়সা ইকবাল সাহেবের হাতে দিয়ে দেব। ইকবাল সাহেব আপনি যা হয় কিছু একটা ব্যবস্থা করবেন।
আকমল সাহেব মাথা চুলকে বললেন, ইকবাল সাহেবের কথাবার্তায় কখনো বেশি পাত্তা দিই নি। মাঝে মাঝে মনে হয় একটা-দুটো ভালো ভালো কথা বলেন। অফিস ছুটির পর আধাঘন্টা সবাই যদি বসি, ইকবাল সাহেব যদি একটু গুছিয়ে বলেন, কেমন হয় তা হলে?
সেকশান অফিসার লুফে নিলেন কথাটা। হ্যাঁ হ্যাঁ, খারাপ না আইডিয়াটা। ঐ সময়ে এমনিতে বাসে যা ভিড়!
আমি কথা বলার সুযোগ পাচ্ছিলাম না, শেষ পর্যন্ত যখন সবাই থামলেন, সুযোগ হল। বললাম, আমাকে একটা কথা বলতে দেবেন?
সবার হয়ে মাওলা সাহেব বললেন, তার আগে বলেন আপনি রাজি আছেন কি না।
ঠিক আছে।
সবার মুখে পরিতৃপ্তির একটা হাসি খেলে যায়। সেটাকে বিস্তৃত হওয়ার সুযোগ দিয়ে বললাম, আমার নামটাও তা হলে পাল্টে ফেলি, কী বলেন? হযরত শাহ বাবা জাফর ইকবাল নকশবন্দী কুতুবপুরী গুলগুলিয়া কেমন শোনাচ্ছে নামটা?
ভুলও হতে পারে, কিন্তু মনে হল কারো কারো চোখ এক মুহূর্তের জন্যে খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।
০৫. হেরোইন কারবারি
কয়দিন থেকেই শরীরের অদ্ভুত অদ্ভুত জায়গায় ব্যথা। মাঝরাত্তিরে ঘুম ভেঙে যায়, তারপরে আর ঘুম আসতে চায় না। অফিসে একজনকে কথা প্রসঙ্গে বলে ফেললাম, শুনে তিনি খুব গম্ভীর হয়ে গেলেন। আমি ভয়েভয়ে বললাম, কী হল?
না, কিছু না। তবে সহকর্মী একটু ইতস্তত করে বলেই ফেললেন, আমার বড় শালার আপন ভায়রা ভাইয়ের ঠিক এরকম লক্ষণ ছিল।
কী হয়েছে তার?
না, কিছু না, শুনে আপনি আবার ভয় পেয়ে যাবেন।
না শুনেই আমি ভয় পেয়ে গেছি, তবু শুনতে চাইলাম, বলুন না, শুনি।
ব্রেন ড্যামেজ আর হার্ট অ্যাটাক একসাথে। ডাক্তার পরে কেটেকুটে দেখেছে লিভার বলতে নাকি কিছু ছিল না। কিডনি দুটোও নাকি একসাথে ফেইল করেছিল। সিগারেট খেত, তাই লাংসের কথা তো ছেড়েই দিলাম।
আমি হাতের সিগারেটটা অ্যাশট্রেতে গুজে দিয়ে নিজের জায়গায় ফিরে এলাম। বসে থাকতে থাকতে আমার হার্ট’ এবং ‘ব্রেন’ ব্যথা করতে থাকে। পিঠের কাছে। অনেকক্ষণ থেকে শির শির করছে, মনে হয় কিডনি দুটোও কেমন জানি হাল ছেড়ে দিচ্ছে। লিভারটা কোথায় ঠিক জানি না, কিন্তু পরিষ্কার বুঝতে পারি সেটাও প্রায় যায়-যায়। সিগারেট খেয়ে খেয়ে নিশ্চয়ই বুকের বারটা বাজিয়ে ফেলেছি। কারণ একটু পরে আমার নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হতে থাকে। দুপুর পর্যন্ত বেঁচে থাকব কি না সন্দেহ হচ্ছিল। কিন্তু বাঁচার শেষ চেষ্টা না করে হাল ছেড়ে দিই কেমন করে? ছুটি নিয়ে আমি তখন-তখনই বের হয়ে পড়লাম আমার এক ডাক্তার বন্ধুর সাথে দেখা করতে। রিকশা করে যেতে-যেতে আমার হাত এবং পায়ের তালু ঘামতে শুরু করে, ডাক্তার বন্ধুর অফিস পর্যন্ত পৌঁছাতে পারব কি না সেটা নিয়েই এখন আমার সন্দেহ শুরু হয়ে গেল।